বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

টানেলের শেষে অবশ্যই আলো রহিয়াছে 

আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ০৬:০০

বিশ্ব আজ বহুবিধ পরিবর্তনের মুখোমুখি। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি-সকল স্তরেই একপ্রকার অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। এই পরিবর্তনের ঢেউ শুধু রাষ্ট্র বা সমাজের গঠনকাঠামোকেই নাড়াইয়া দেয় নাই; ইহা ব্যক্তিজীবনের গহিনেও স্পষ্ট রেখাপাত করিতেছে। স্বাভাবিকভাবেই, দিনদিন মানুষের মানসিক চাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহা এমন এক দুর্মর চাপ, যাহা বাহির হইতে দৃশ্যমান নহে; কিন্তু ভিতরে ভিতরে একজন ব্যক্তিকে নিঃশেষ করিয়া দেয়। ইহা একপ্রকার নীরব ঘাতক-যাহার নির্মম শিকার হইতেছে বর্তমান বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।

আধুনিক জীবনের জটিলতা, দ্রুতগতি, প্রতিযোগিতা এবং নিরাপত্তাহীনতা-সকল মিলাইয়া যেন মানসিক চাপকে অবধারিত করিয়া তুলিয়াছে। যাহা পূর্বে কেবল বড় শহরের নাগরিকের সমস্যা বলিয়া ধরা হইত, তাহা আজ গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত বিস্তার লাভ করিতেছে। সামাজিক টানাপড়েন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পারিবারিক টানাপড়েন, বিচ্ছিন্নতা ও কর্মসংস্থানের অভাব-এই সকল কারণ মিলাইয়া মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিতেছে। ফলে প্রশ্ন উঠে-এইভাবে কি সত্যিই বাঁচা যায়? বিশ্ব জুড়িয়া যুদ্ধ, সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনীতির সংকট এবং ব্যক্তিগত জীবনের গ্লানি, ব্যর্থতা-সমস্ত কিছু মিলাইয়া যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে একপ্রকার অন্তহীন দুঃস্বপ্নে পরিণত করিয়াছে। মনে হইতে পারে, এই পৃথিবীতেই মানুষ যেন দোজখের অনুশীলন করিতেছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র একপ্রকার বিষন্নতা, শঙ্কা ও ক্লান্তির ছায়া বিরাজমান। যাহারা স্বপ্নের বাহক এবং ভবিষ্যতের নির্মাতা, তাহারাও অনিশ্চয়তার মধ্যে দোদুল্যমান।

তবে ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, এই রূপ সংকট মানবজীবনে নূতন নহে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীরাও জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে মানসিক চাপে পিষ্ট হইয়াছিলেন; কিন্তু তাহারা আত্মোপলব্ধি, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা এই সংকট উত্তরণ করিয়াছেন। আত্মোপলব্ধিই হইতেছে মানসিক চাপ মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান ধাপ। নিজেকে জানিবার মধ্য দিয়া জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়; তাহাতেই তৈরি হয় একপ্রকার 'সেফটি ভাল্ব', যাহা প্রবল চাপেও ব্যক্তিকে ধ্বংস হইতে রক্ষা করিতে পারে। উইনস্টন চার্চিল একবার বলিয়াছিলেন, 'আমার জীবনের অধিকাংশ উদ্বেগ কখনোই বাস্তবে ঘটে নাই।' ইহা বলিবার মাধ্যমে তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, আমাদের অনেক উদ্বেগই কল্পনাপ্রসূত। খলিল জিবরান বলিয়াছিলেন, 'উদ্বেগ ভবিষ্যতের ঘটনা নয়, বরং ইহাকে নিয়ন্ত্রণের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা।' এই সত্য অনুধাবন করিলেই বোঝা যায়-উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কেবল বাহ্যিক পরিস্থিতির কারণে নহে, বরং অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও সৃষ্ট হয়।

সমসাময়িক কিশোর সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচয়িতা জে কে রাউলিং বলিয়াছেন, 'কোনো কিছুতে ব্যর্থ না হইয়া বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব।' অর্থাৎ, ব্যর্থতা জীবনেরই একটি স্বাভাবিক অংশ; বরং ইহার মধ্যেই লুকাইয়া থাকে পরবর্তী সাফল্যের বীজ। কখনো কখনো মনে হইতে পারে, টানেলের শেষে কোনো আলোর রেখা নাই; কিন্তু ইহা নিছক বিভ্রম। কারণ, আমরা কোনোভাবেই আমাদের 'ভবিষ্যৎ' জানি না। ইহা একমাত্র সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা জানেন। অতএব, ভবিষ্যৎ লইয়া এত অস্থির-উদ্বিগ্ন হইয়া কোনো লাভ নাই। বরং অস্থিরতা-উদ্বিগ্নতা আমাদের মধ্যে যেই মানসিক চাপ তৈরি করে, তাহা নীরব ঘাতক। সুতরাং জয় করিতে হইবে মানসিক চাপ। মানসিক চাপকে জয় করিবার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রার্থনার গভীরতা। প্রয়োজন পারস্পরিক সহানুভূতি, মানবিক সংবেদনশীলতা এবং সামাজিক সংহতি। যেই সমাজ ব্যক্তিপর্যায়ের দুঃখ-কষ্টকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করে, সেই সমাজই স্বাস্থ্যকর ও স্থিতিশীল সমাজে পরিণত হয়।

সুতরাং, আধুনিক জীবনের এই দুঃসহ পথপরিক্রমায় 'নিজের উপর আস্থা রাখা' সবচাইতে জরুরি। টানেল যত লম্বাই হউক না কেন, তাহার শেষে অবশ্যই আলো রহিয়াছে-এই বিশ্বাসেই আমাদের আগাইতে হইবে। এই বিশ্বাসই আমাদের রক্ষাকবচ।

ইত্তেফাক/এএম