ভারত ও পাকিস্তান—দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর সম্পর্ক বরাবরই উত্তপ্ত থাকে। তবে ২০২৫ সালের এপ্রিল ও মে মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দুই দেশের মাঝে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ভয়ানক করে তুলেছে। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বিমান হামলা, ড্রোন হামলা এবং সামরিক প্রস্তুতি যেন যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি দেখা দিয়েছে সেটি হলো এই যুদ্ধ কি পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে?
ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথম পরমাণু পরীক্ষা চালায় এবং ১৯৯৮ সালে নিজেদের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে ভারতের কাছে ১৮০টির বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে ছয়টি পরীক্ষা চালিয়ে নিজেদের পারমাণবিক শক্তির কথা জানান দেয়। বর্তমানে তাদের কাছে ১৭০টির বেশি ওয়ারহেড রয়েছে।
উভয় দেশের অস্ত্রই একে অপরকে হামলা করার জন্য উপযুক্ত। ভারত রাশিয়ার সহযোগিতায় জাহাজ ও সাবমেরিনভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সহায়তায় মোবাইল স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে।
তাদের পারমাণবিক মতবাদ কী বলে?
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান হলো "প্রথমে ব্যবহার নয়" (No First Use - NFU)। ভারতের মতে, তারা কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র প্রথম ব্যবহার করবে না। যদি কেউ ভারতকে পারমাণবিক হামলা করে, তখনই তারা জবাব দেবে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের কিছু রাজনৈতিক নেতা বলছেন, পরিস্থিতি বদলালে এই নীতিও বদলাতে পারে। ২০১৯ সালে ভারতের বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, আমরা এখনো NFU নীতি মেনে চলছি, তবে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের অবস্থান হলো "প্রথমেই ব্যবহার করা হতে পারে"। পাকিস্তান কখনোই NFU নীতি অনুসরণ করেনি। তারা বরাবরই বলেছে, প্রয়োজনে প্রথমেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তারা। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারতকে হুমকি দিয়ে পাকিস্তানের পারমাণবিক উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারি।
পাকিস্তান ২০১১ সাল থেকে ছোট আকারের পারমাণবিক অস্ত্র, অর্থাৎ ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন (TNW) তৈরি করছে, যা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অস্ত্রও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক এবং সীমান্তবর্তী এলাকাতেও ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, উভয় দেশের জন্যই পারমাণবিক হামলা চালানো একেবারে আত্মঘাতী হবে। তবে এটাকে একদম অসম্ভব ভাবার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞ লোরা সালমান বলেন, যখন দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক নীতিতে অস্পষ্টতা থাকে, তখন অনিচ্ছাকৃত ভুল বা লাল রেখা অতিক্রমের সম্ভাবনা থাকে। আবার এ ধরনের ভয়ই অনেক সময় যুদ্ধ ঠেকায়।
যদিও দুই দেশই সরাসরি পারমাণবিক হামলার হুমকি দেয়নি, তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল সিদ্ধান্তে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ শুধু এই অঞ্চলের নয়, পুরো বিশ্বের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই অবস্থায় কূটনৈতিক সমাধানই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিল, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে ভয়াবহ এক হামলায় নিহত হন ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় গাইড। ভারত দাবি করে, এই হামলার পেছনে পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত আছে। যদিও পাকিস্তান এতে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে। সেই থেকে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, ও একের পর এক সামরিক পদক্ষেপ।
৭ মে থেকে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের ভেতরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাতে শুরু করে। ভারতের দাবি, তারা সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, এসব হামলায় বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ১০ মে, শনিবার ভোরে। পাকিস্তান জানায়, ভারত তাদের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। জবাবে পাকিস্তান ভারতের সাতটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। এই পাল্টাপাল্টি হামলা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা