সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

তিন কাহিনি ও একটি সত্য

আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০২:৩০

মানবসমাজের ইতিহাসে এমন বহু দৃষ্টান্ত রহিয়াছে, যেইখানে একজনের অপরাধের ফল ভোগ করিতে হয় তাহার নিকটবর্তী নির্দোষ ব্যক্তিদের। কখনো ব্যক্তির দোষে গোটা সম্প্রদায়কে দণ্ডিত করা হইয়াছে, আবার কখনো একটির সহিত থাকার অপরাধে নিরপরাধ ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে বহন করিতে হইয়াছে অপমান ও দুঃখের ভার। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি প্রচলিত কাহিনি উল্লেখ করা যাইতে পারে। আফ্রিকার ছোট দেশ 'বুর্কিনা ফাসো'র অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ট্রাওরেকে কেন্দ্র করিয়া একটি বহুল আলোচিত অ্যানেকডট রহিয়াছে। বলা হয়, একদিন তিনি সাধারণ পোশাকে বিমানযোগে ভ্রমণ করিতেছিলেন বিজনেস ক্লাসে। বাহ্যিকভাবে তাহার মধ্যে রাষ্ট্রপতির কোনো পরিচয় ছিল না। উক্ত বিমানে এক ফরাসি ধনী যাত্রীর আরামের স্বার্থে বিমানসেবিকা তাহাকে ইকোনমি ক্লাসে স্থানান্তরের অনুরোধ করেন। পরবর্তী সময়ে যখন জানা যায় ইব্রাহিমই রাষ্ট্রপতি, তখন উক্ত ফরাসি যাত্রী ও বিমানসেবিকা বিপদে পড়েন। তাহাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা লওয়া হয়। কথিত আছে, ইব্রাহিম তখন বলেন, 'বুর্কিনা ফাসো আর কোনো উপনিবেশ নহে এবং বিচার হইবে আইনের পথ ধরিয়া।'

ইহা যদি অ্যানেকডট হইয়াও থাকে, তাহার পরও ইহার অন্তর্নিহিত শিক্ষা গভীর। যিনি অনুরোধ করেন নাই, তিনি যেন কেবল নিজের অস্তিত্বের কারণেই অন্যের অপমানজনিত শাস্তির কারণ হইলেন। একই রকম আরেকটি কাহিনি আমরা স্মরণ করিতে পারি। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশরা একবার একজন বিপ্লবীর জন্য গোটা গ্রাম বা সম্প্রদায়কে দায়ী করিয়া নির্মম শাস্তি প্রদান করিয়াছিল। উনিশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের এক গ্রামে এমনই একটি ঘটনা ঘটে। একজন যুবক ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যা করিয়া তাহার নিজ গ্রামে আত্মগোপন করিলে, গোটা গ্রামকেই 'বিদ্রোহে সহায়তা'র অভিযোগে দগ্ধ করা হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ-কেহই রক্ষা পান নাই। ঠিক এই রূপ চিত্র দেখা গিয়াছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ষাটের দশকে। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের অধিকার আন্দোলনের সময় অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি, ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে, আন্দোলনে যোগদান করেন; কিন্তু তাহাদের এই সহানুভূতি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের রোষানলে পড়ে। ১৯৬৫ সালে রেভারেন্ড জেমস রেব নামক এক শ্বেতাঙ্গ ধর্মযাজক সেলমা শহরের এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের অপরাধে উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হন। ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলিয়াছিলেন, 'তিনি কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নহে, সমগ্র আমেরিকাকে আরো ন্যায়নিষ্ঠ করিবার লক্ষ্যে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন।'

এই তিনটি কাহিনির মধ্যে এক অভিন্ন সূত্র রহিয়াছে-একজনের কৃতকর্মের জন্য কিংবা অবস্থানের জন্য তাহার সহিত থাকা নিরীহদেরও শাস্তি ভোগ। ইব্রাহিম ট্রাওরের কাহিনি, সত্য কিংবা কল্পিত, আমাদের সচেতন করুক যে, পদে থাকিলেও, বাহুবলে নহে, বিচারে শ্রেষ্ঠত্ব দেখাইতে হয়। ব্রিটিশ শাসনের নির্মমতা বা আমেরিকার সামাজিক বিদ্বেষ-উভয়ের ইতিহাসেই শিক্ষা এই, অপরাধী যেই হউক, তাহার অপরাধে নির্দোষের শাস্তি ন্যায়বিরোধী। আধুনিক বিশ্ব যত বেশি সভ্য হইতেছে, ততই সভ্যজগৎ অনুধাবন করিতে পারিতেছে-নির্দোষ কেহ যেন অন্যের দোষের বলি না হয়। অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বকে ক্রমশ সভ্যতার পরিমার্জিত আধুনিক পাঠগ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। নচেৎ পিছাইয়া পড়িতে হইবে সমগ্র সভ্য সমাজ হইতে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন