বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

তালেবানের সঙ্গে দিল্লির যোগাযোগ কীভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে? 

আপডেট : ২৩ মে ২০২৫, ০৯:৩৭

আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে ভারতের কোনো সরকারের 'রাজনৈতিক যোগাযোগ' শেষবার যখন স্থাপিত হয়, সেটা ২৫ বছরেরও আগেকার কথা। কাবুলে তখন ভারতের কোনো দূতাবাস পর্যন্ত ছিল না। তারপরও সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশওয়ন্ত সিং তার আফগান কাউন্টারপার্ট মুল্লাহ্ ওয়াকিল আহমেদ মুত্তাওয়াকিলকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

কারণটা ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবোঝাই বিমান আইসি ৮১৪-কে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কান্দাহার এয়ারপোর্টে– আর পণবন্দি সেই যাত্রীদের মুক্তি কোন শর্তে হতে পারে, তা নিয়ে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ভারতের আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল তালেবান। 

সেই একটি বিশেষ সংকটের মুহূর্ত ছাড়া তালেবানের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক তৈরিতে ভারতের দিক থেকে তেমন আগ্রহ কখনোই ছিল না, আর তা অনেকগুলো কারণেই!

এরপর ২০২১ সালের অগাস্টে তালেবান যখন আবার কাবুলের ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন ভারত সে দেশে তাদের সব দূতাবাস ও মিশনেই তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আফগানিস্তানে ভারতের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও পুরোপুরি থমকে যায়।  

তবে বাস্তবতা হলো, এরপরও দু'পক্ষের মধ্যে 'টেকনিক্যাল' ও 'কূটনৈতিক' স্তরে একাধিকবার কথাবার্তা হয়েছে; চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুবাইতে বৈঠকও করেছেন।  

কিন্তু সেই ১৯৯৯ সালের পর ভারত সরকারের কোনো মন্ত্রী তালেবান মন্ত্রীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ করছেন – এমন ঘটনা আর ঘটেইনি। সেই নজিরও অবশেষে ভাঙল গত সপ্তাহের ১৫ই মে – ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়ার ঠিক পাঁচদিনের মাথায়। 

সে দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে জানালেন, সন্ধ্যেবেলায় ভারপ্রাপ্ত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে খুব ভালো কথাবার্তা হলো।

পেহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলায় তার নিন্দা জানানোকে ভারত যে গভীরভাবে সম্মান করে, সেটাও জানালেন জয়শঙ্কর।

এবং কোনো দেশের নাম না করে এটাও উল্লেখ করলেন, সম্প্রতি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খবর ছড়িয়ে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করার চেষ্টাকে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেরকম দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাকেও স্বাগত জানিয়েছি। 

এখানে তার অভিযোগের নিশানা যে ছিল পাকিস্তানের দিকে, তা বুঝতে অবশ্য কোনো অসুবিধা হয়নি।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুম্বাইতে আফগান কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে টুইট করে জানানো হয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক যোগাযোগকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় এবং কীভাবে দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যায়– তা নিয়েও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময় হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আফগান ব্যবসায়ী ও রোগীদের যাতে ভারত ভিসা দেয় এবং ভারতের জেলে আটক আফগানদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরত পাঠায়- আলোচনার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি সেই অনুরোধও জানান।

কীভাবে দুই দেশ মিলে ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে কাজ করতে পারে, কথা হয় তা নিয়েও। 

যে দুটো দেশের মধ্যে একটা ব্যবহারিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত নেই, তাদের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয় নিয়ে এরকম বিস্তারিত আলোচনা অত্যন্ত বিরল– আর সে কারণেই জয়শঙ্কর ও মুত্তাকির টেলিফোন আলাপ নিয়ে এতটা চর্চা হচ্ছে। 

কিন্তু কী সেই ফ্যাক্টর, যা দিল্লি ও কাবুলকে এভাবে কাছাকাছি আনল? দুই দেশ কি এরপর পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির পথে এগোবে? নিজেদের সম্পর্কের ভেতর পাকিস্তান ইস্যুটাই বা দুই দেশ কীভাবে সামলাবে?

আর একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন– সমাজে নারীর অধিকার সঙ্কুচিত করার ব্যাপারে তালেবানের যে ট্র্যাক রেকর্ড, তাতেই বা ভারতের অবস্থান কী হবে?

এখনো যে এই সব প্রশ্নের উত্তর পুরোপুরি স্পষ্ট তা নয় – তবে কিছুটা আভাস অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে!

'পাকিস্তানই কাছাকাছি এনেছে'

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংকট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মদান পরিষ্কার বলছেন, এই যে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা টেলিফোনে নিজেদের মধ্যে কথা বললেন, এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যদি কারও থেকে থাকে সেটি অবশ্যই পাকিস্তানের!

পাকিস্তানের 'ম্যাসিভ অ্যাসিস্ট' বা বিরাট সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভবই ছিল না, বলছেন তিনি।

আসলে 'শত্রুর শত্রুই আমার বন্ধু'– এই ভাবনা জিওপলিটিক্সের ক্ষেত্রেও সমানভাবেই প্রযোজ্য এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতিকেই যে ভারত কূটনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই! 

দিল্লিতে স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট অতুল আনেজা বলছেন, তালেবান ১.০ যে পাকিস্তানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল এবং তাদের নেতারা কার্যত পাকিস্তানের হাতে গড়া ছিলেন, এটা সবাই জানেন। কিন্তু তালেবান ২.০-র সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে। 

বস্তুত পাকিস্তান বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে আফগান তালেবানই আসলে 'তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান' বা টিটিপি-কে মদত দিয়ে আসছে এবং আফগানিস্তানের ভেতরে তালেবান নাকি তাদের জন্য বেশ কিছু 'পকেট' বা মুক্তাঞ্চল পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছে।

এই টিটিপি পাকিস্তানেও সরকারকে উচ্ছেদ করে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করার কথা বলে। 

যার জেরে গত বছরের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের ভেতরে বেশ কিছু এলাকায় পাকিস্তান আকাশপথে হামলা পর্যন্ত চালিয়েছে, পাকতিকা প্রদেশে এমন একটি হামলায় প্রায় ৫০জন নিহতও হয়েছেন। পাল্টা জবাব দিয়েছে তালেবানও। 

অতুল আনেজার মতে, ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান দূরত্বকেই ভারত কাজে লাগাতে চাইছে– যাতে দিল্লিরও প্রভূত স্বার্থ আছে।

'পাকিস্তান খুব সরু একটা দেশ, ভারতের তুলনায় তো কিছুই নয়। পাকিস্তান চিরকাল আফগানিস্তানকে কাছে টানতে চেয়েছে, কারণ তারা সঙ্গে থাকলে পাকিস্তানের এই স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ (গভীরতা) বাড়ে, তাদের জন্য মধ্য এশিয়ার দরজাও খুলে যায়।'  

আবার ঠিক সেই একই কারণে ভারতও চায় আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের চেয়ে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে, বলছিলেন অতুল আনেজা।

এই পটভূমিতে গত মাসে পহেলগাম হামলায় নিরীহ পর্যটকরা নিহত হওয়ার পর আফগানিস্তানের তালেবান শাসকরা যেভাবে তার নিন্দা করেছেন, তা যথারীতি দিল্লি ও কাবুলের মধ্যে যোগাযোগ ঝালিয়ে নেওয়ার একটা দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছিল– এস জয়শঙ্কর তা সঙ্গে সঙ্গে লুফেও নিয়েছেন।

তা ছাড়া চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপেক) এখন আফগানিস্তানের দিকেও 'ওয়াখান করিডরে'র মাধ্যমে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে– এই খবরের দিকেও ভারত সতর্ক নজর রাখছে।

ফলে আফগানিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের তাগিদ ভারতের দিক থেকেও যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকারান্তরে পাকিস্তানই (বা কাবুলের সঙ্গে তাদের এখনকার সাপে-নেউলে সম্পর্কই) আসলে সেটা সম্ভব করেছে বলে দিল্লিতে বহু পর্যবেক্ষকের বিশ্বাস।

কূটনৈতিক সম্পর্ক কতটা গভীর হওয়া সম্ভব?

দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে ফোনে কথাবার্তা হলেও তা যে এখনো পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ প্রশস্ত করে দেবে বা ভারত কাবুলের তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে, সেটা অবশ্য অনেকেই মনে করছেন না।

এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে ভারতের কোনো দূতাবাস চালু নেই। শুধু ২০২২ সালে তারা কাবুলে একটি 'টেকনিক্যাল মিশন' আংশিকভাবে শুরু করেছে, যার দায়িত্বে আছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। অন্য দিকে দিল্লিতেও আফগান দূতাবাসের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে বছর দেড়েকের ওপর হলো।

রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান বা উজবেকিস্তানের মতো অনেকে তাদের দেশে আফগান মিশনগুলোর অপারেশন তালেবানের হাতে তুলে দিলেও ভারত কিন্তু সেই দলে এখনো নাম লেখায়নি।

তবে গত বছরের নভেম্বরে তালেবান যখন মুম্বাইতে তাদের কনস্যুলেটে ইকরামউদ্দিন কামিলকে 'ভারপ্রাপ্ত কনসাল' হিসেবে নিয়োগ করে – ভারত তাতে কোনো আপত্তি জানায়নি, আবার তিনি প্রথামাফিক ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে এখনো তার পরিচয়পত্রও পেশ করেননি। 

ইকরামউদ্দিন কামিল ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়েই তার স্নাতকোত্তর পড়াশুনো ও পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন দিল্লির সাউথ এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে। ফলে এই আফগান কূটনীতিকের সঙ্গে ভারতের নীতিনির্ধারকদের অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্কও বেশ ভালো। মুম্বাইতে তার নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্টরও কাজ করে থাকতে পারে।

তবে জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক রাঘব শর্মা মনে করেন না, খুব শিগগিরি দিল্লি ও কাবুলে দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাবে।

আসলে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই তালেবানের সঙ্গে এনগেজ করে আসছে, কিন্তু তার ব্যাপ্তিটা কত– সেটা নিয়ে মুখ খোলায় তাদের একটা প্রবল অনীহা বা দ্বিধা আছে। ফলে তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক এনগেজমেন্টের ক্ষেত্রে আমি তো বলব ভারত এখনো মাঠের বাইরেই ঘোরাফেরা করছে, বলছিলেন তিনি।

অধ্যাপক শর্মা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মার্কিন থিংকট্যাংক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের একটি সাম্প্রতিক স্টাডিতেও বলা হয়েছে– কাতার, চীন, বা তুরস্কের মতো দেশগুলো তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যেখানে বহুদূর এগিয়ে গেছে, এমনকি পাকিস্তানের নামও এই তালিকার পাঁচ নম্বরেই আছে– সেখানে ভারত কিন্তু ধারেকাছেও কোথাও নেই!

আসলে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারত তাদের 'শত শত বছরের গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্কে'র কথা বারেবারে বললেও বাস্তবে সেটা আজকের দিনেও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে 'খুব একটা কাজের কাজ কিছু হয়নি' বলেই মনে করেন রাঘব শর্মা।

নতুন 'ভিসা রেজিম' ছবিটা পাল্টাতে পারে?

আফগানিস্তানে ২০২১ সালের অগাস্টে তালেবানের ক্ষমতা দখল, আর তার ঠিক তিন বছর পর বাংলাদেশে ২০২৪ সালের অগাস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দুটো ক্ষেত্রেই ভারতের আচরণে একটা অদ্ভুত মিল ছিল।

এই সাদৃশ্যটা আর কিছুই না– ওই দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া!

কয়েক বছর আগেও দলে দলে আফগান ব্যবসাপাতি, পড়াশুনো, ডাক্তার দেখানো ও আরও নানা কাজে নিয়মিত ভারতে আসতেন, একটা সময় দিল্লি ও কাবুলের মধ্যে রোজ তিন জোড়া ফ্লাইটও যাতায়াত করত।

কিন্তু কাবুল-কান্দাহার-জালালাবাদ বা হীরাটে ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারতের কনস্যুলার পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায়, আফগানদের জন্য ভারতে আসাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে যেমন এখনো ভারত খুব জরুরি প্রয়োজন বা মেডিক্যাল কারণ ছাড়া ভিসাই দিচ্ছে না, ঠিক একইভাবে খুব কম আফগানই গত কয়েক বছরে ভারতে আসতে পেরেছেন – শুধু যাদের আগে থেকেই 'লং টার্ম ভিসা' ছিল তারা ছাড়া! 

কাবুলের তালেবান নেতৃত্ব এখন ভীষণভাবে চাইছে ভারত আবার আগের মতো আফগানিস্তানে তাদের ভিসা কার্যক্রম চালু করুক। গত সপ্তাহের টেলিফোন আলাপে আমির খান মুত্তাকি জয়শঙ্করকে সরাসরি সে অনুরোধও জানিয়েছেন।

অন্তত আফগানিস্তানের ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও চিকিৎসার জন্য ভারতে আসতে ইচ্ছুক রোগীদের ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে দুই দেশের মানুষে মানুষে সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষকেরই ধারণা।

ঘটনাচক্রে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে টেলিফোন আলাপের পরদিনই (১৬ মে) পাকিস্তানের আটারি সীমান্তে আটকে থাকা আফগানিস্তানের ১৬০টি পণ্যবাহী ট্রাককে 'বিশেষ অনুমতি' দিয়ে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়। এই ট্রাকগুলোতে ছিল পেস্তা-কিসমিস-আখরোটের মতো নানা শুকনো ফল।

গত মাসে পহেলগাম হামলার পর থেকেই ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আটারি-ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলে আফগানিস্তান থেকে আসা এই ট্রাকগুলো আটকে পড়ে।

এখন ভারত যদি এই 'সৌজন্য'টা ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখায়, তাহলে তালেবানের সঙ্গে আস্থার সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে উঠতে পারে।

বিগত দুই দশকে ভারত আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ, সে দেশের কর্মকর্তা ও ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ, এমনকি আফগানিস্তানের নতুন জাতীয় পার্লামেন্ট ভবন তৈরির কাজে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছিল। 

তালেবান কর্মকর্তা ও মুখপাত্ররা তাদের একাধিক পোস্টে স্পষ্ট করে দিয়েছেন– সেই সব প্রকল্প আপাতত মুলতুবি থাকলেও ক্ষতি নেই– কিন্তু সাধারণ আফগান নাগরিকদের আবার ভিসা দেওয়া শুরু করে ভারতকেই এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা দুদেশের মধ্যে 'পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্টে' সত্যিই আগ্রহী!

তালেবানের নারী নীতি নিয়ে ভারতের অবস্থান কী?

আজ পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা দেশ যে তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি, তার প্রধান কারণ সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে তালেবানের নীতি – যে নারীরা ঘরের বাইরে বেরোতে পারবেন না, শিক্ষায়-কর্মক্ষেত্রে-খেলাধুলোয় তাদের কোনো যোগদান থাকারই দরকার নেই।

বছর চারেক আগে তালেবান কাবুলের ক্ষমতায় আসার পর আফগান নারীরাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। ব্যাংক, স্কুল-কলেজ বা এনজিওতে যে হাজার হাজার আফগান নারী কাজ করছিলেন তারা এখন আবার ঘরের চার দেওয়ালে আটকা পড়েছেন। যাদের সুযোগ ছিল তারা অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।

এমনকি, আফগানিস্তানের যে নারী ক্রিকেট টিম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল, সেই টিমও কার্যত ভেঙে গেছে – ক্রিকেটাররা কেউ খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক বা মেলবোর্নে পালিয়ে গেছেন।

একটু অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু ঘটনা হলো আফগানদের যে পুরুষ ক্রিকেট টিমকে ভারত বছরের পর বছর ধরে লালন করেছে এবং দিল্লির কাছে গ্রেটার নয়ডা বা দেরাদুনকে আফগান ক্রিকেটের 'হোম' হিসেবে গড়ে তুলেছে – তারাও কিন্তু সে দেশের নারী ক্রিকেটের এই বিপদে পাশে দাঁড়ায়নি বা দাঁড়াতে পারেনি।

আসলে সমাজে নারীদের প্রতি তালেবানের 'দমনপীড়নের নীতি'টাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য এতদিন সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে থেকেছে।

তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে করাই যেতে পারে, আপাতত সে সব বিষয়গুলো উপেক্ষা করে ভারত এখন নিরাপত্তা ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে – আর তালেবানকে রাজনৈতিক পর্যায়েও 'রিচ আউট' করার সেটাই প্রধান কারণ!

পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার অজয় বিসারিয়ার কথায়, আমি বলব ভারত এক্ষেত্রে একটা প্র্যাগম্যাটিক বা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তালেবানের সঙ্গে ডিল করতে চাইছে।

বিষয়টা খুব সহজ – ভারত চাইছে আফগান ভূখণ্ডকে যেন কিছুতেই ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহার না করা হয়। বিনিময়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত এনগেজমেন্ট ও আফগানিস্তানে মানবিক ত্রাণ ও সাহায্য অব্যাহত থাকবে, এই বার্তাটাই দিতে চাওয়া হচ্ছে, বলছিলেন তিনি।

এই ধরনের কোনো আলোচনায় দু'পক্ষের জন্যই অস্বস্তিকর বিষয় কেউই তুলতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক– আর সে কারণেই বর্তমান আফগান সমাজে নারীদের অবস্থান নিয়ে কোনো কথাও হচ্ছে না। 

ভারতের খুব জনপ্রিয় টিভি নিউজ অ্যাংকর পালকি শর্মা সম্প্রতি তার অনুষ্ঠানে এই বিষয়টাকেই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন।

আফগানিস্তানে নারীদের দুর্দশা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আফগানিস্তানের নাগরিকদের মানবাধিকার বা নিরাপদ জীবনযাত্রা নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের কি কোনো উদ্বেগ নেই? নিশ্চয়ই আছে!

"কিন্তু ভারতের জনগণের নিরাপত্তা, ভালো থাকাটা নিশ্চয়ই ভারতের কাছে অনেক বেশি অগ্রাধিকার পাবে, তাই না? এটাই স্বাভাবিক আর এখন ঠিক এটাই ঘটছে!"

ভারত সরকারের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরাও একান্ত আলোচনায় এই যুক্তিটাই দিচ্ছেন– যে ভারতের বৃহত্তর ও সার্বিক স্বার্থ দেখতে গিয়েই তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা চলছে, তবে তার মানে এই নয় যে তাদের সব নীতিতেই দিল্লি চোখ বন্ধ করে সায় দিচ্ছে।

তাদের কথায়, এই সম্পর্ক 'শুধু পারস্পরিক প্রয়োজনের তাগিদে– সমমনা বন্ধুদের মধ্যে কিছু নয়'।-বিবিসি 

ইত্তেফাক/এসআর