তালেবানকে বিশ্বের কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, অথচ সেই আফগানিস্তানকে কাছে টানার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো।
তিনি একইসঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন, এবং ইরান ও চীন সফর করেছেন। বেইজিংয়ে তিনি আবারো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এমনকি বুধবার (২১ মে) তিনি পাকিস্তান ও চীনের প্রতিনিধিদলসহ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন।
এমনকি তালেবানের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যেসব দেশের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, তাদের সঙ্গেও এখন সম্পর্ক ভালো করতে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, যার সঙ্গে এখন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। জাতিসংঘ বা এর কোনো সদস্য রাষ্ট্রই তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবুও বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানের এই কূটনৈতিক তৎপরতা দেখায় যে, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একেবারে একঘরে হয়ে পড়েনি।
ভারত কেন তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে?
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে ভারত তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি এবং তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখন কেবল পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবই তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভারত তখন সোভিয়েত-সমর্থিত মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর সরকারের পক্ষে ছিল এবং তালেবান ক্ষমতায় আসার পর কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। ভারত মনে করতো, তালেবান পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর হাতের পুতুল, যারা মুজাহিদদের মস্কোর বিরুদ্ধে সমর্থন দিচ্ছিল। তালেবানের বিরোধিতায় ভারত ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ নামক একটি জোটকে সমর্থন করত।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তালেবানদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর ভারত আবার কাবুলে দূতাবাস চালু করে এবং আফগানিস্তানে উন্নয়ন প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন ডলার (৩০০ কোটি ডলার) এর বেশি বিনিয়োগ করে—যার মধ্যে অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানি সরবরাহ প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত। তবে এরপর তালেবান ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্ক ভারতীয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর উপর একাধিক প্রাণঘাতী হামলা চালায়।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরে আসলে, ভারত তাদের দূতাবাস খালি করে এবং সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আগের অবস্থান বজায় রাখে। তবে এবার, আগের সময়ের মতো একেবারে সম্পর্ক ছিন্ন না করে, ভারত পর্দার আড়ালে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে এবং পরে তা কিছুটা প্রকাশ্যেও চলে আসে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই কৌশলের পেছনে রয়েছে একটি সহজ যুক্তি। আগেরবার তালেবানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার ফলে আফগানিস্তানে প্রভাব পাকিস্তানের হাতে চলে গিয়েছিল। ভারত সেই ভুল আবার করতে চায় না।
২০২২ সালের জুনে, তালেবানের ক্ষমতা দখলের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ভারত কাবুলে আবার দূতাবাস চালু করে, তবে এটি ‘কারিগরি বিশেষজ্ঞদের’ দিয়ে চালানো হয়। এরপর ২০২৪ সালের নভেম্বরে তালেবান মুম্বাইয়ের আফগান কনস্যুলেটে একজন ভারপ্রাপ্ত কনসাল নিয়োগ দেয়।
এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রী ও তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দুবাইয়ে মুখোমুখি বৈঠক করেন—এটি এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরাসরি সাক্ষাৎ। নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কবির তানেজা বলেন, ‘কাবুলে যেই রাজনৈতিক বাস্তবতা আসুক না কেন, তা অস্বীকার করা ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘তালেবানকে কেউই পছন্দ করছে না, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে – এখন ওরাই ক্ষমতায়। ভারতের দীর্ঘদিনের আফগান জনগণের সঙ্গে গড়ে তোলা সম্পর্ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও একেবারে ধ্বংস হয়নি।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এমনকি তালেবানের আদর্শিক ঘাঁটি, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাও ভারতের ভিতরেই অবস্থিত। এসব সম্পর্ক মুছে ফেলা সম্ভব নয়, বরং বাস্তব ও কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করতেই হবে।’
পাকিস্তানের হিসাব-নিকাশ কী?
১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তালেবানের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল পাকিস্তান। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে গেছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে সহিংস হামলা অনেক বেড়ে যায়। ইসলামাবাদ দাবি করে, এসব হামলার জন্য দায়ী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা আফগানিস্তান থেকে করে। পাকিস্তান অভিযোগ করে, তালেবান সরকার তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। তবে তালেবান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চালানো তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র সময় টিটিপি গঠিত হয় এবং তখন থেকেই তারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে। যদিও আফগান তালেবান ও পাকিস্তান তালেবান আলাদা গোষ্ঠী, তবুও তাদের আদর্শগত মিল আছে বলে মনে করা হয়।
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের পরিচালক রাবিয়া আখতার বলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দারের কাবুল সফর ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকির সঙ্গে আলোচনা ‘এক ধরনের সাময়িক বরফ গলা’ হলেও, এটা সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তন নয়। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় ইসলামাবাদ ভয় পাচ্ছিল যে, আফগানিস্তান তাদের ভূখণ্ড ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে পারে। তাই তারা পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করতে এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এছাড়া, পাকিস্তান এই বছরের শুরুতে অনেক আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠাতে শুরু করে, যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার একটি বড় কারণ। সীমান্ত বন্ধ করে বাণিজ্য বন্ধ করাও সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরেকটি দিক।
তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেন, কাবুল ইসলামাবাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, তবে সেটা পারস্পরিক হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের দিক থেকে বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন পাকিস্তান লাগোয়া সীমান্তে চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে, যেন কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে না পারে। ‘তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব, আমাদের না,’ বলেন তিনি।
রাবিয়া আখতার মনে করেন না যে, দুই দেশের মধ্যে মূল অবিশ্বাস—বিশেষ করে টিটিপি-র আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ সহজে মিটে যাবে। তিনি বলেন, ‘এই পরিবর্তনকে পাকিস্তানের ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংকট পরবর্তী ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ হিসেবে দেখতে হবে, কোনো স্থায়ী সমঝোতা নয়।’
ইরান কেনো সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে
ইরান তালেবানের সঙ্গে এখন সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে, যদিও একসময় তারা তালেবানের কড়া বিরোধী ছিল। ১৯৯৮ সালে তালেবান যখন ইরানের কূটনীতিকদের হত্যা করে, তখন ইরান প্রায় যুদ্ধ শুরু করেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
ইরান আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন মেনে না নিলেও, বাস্তব কারণে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। ইরান চায় আফগানিস্তান থেকে আসা পানির প্রবাহ ঠিকঠাক থাকুক, কারণ হেলমান্দ নদীর পানি ইরানের পূর্বাঞ্চলের জন্য খুবই দরকারি। এছাড়া, ইরানে প্রচুর আফগান শরণার্থী আছে, যাদের সমস্যা সমাধানে তালেবানের সহযোগিতা দরকার।
আরেকটি বড় কারণ হলো, আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের প্রভাব বেড়েছে, যারা ইরানেও হামলা চালিয়েছে। তালেবানও এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, তাই ইরান চায় এই বিষয়ে তারা একসঙ্গে কাজ করুক।
সব মিলিয়ে, ইরান তালেবানকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও, নিরাপত্তা, পানি, শরণার্থী ও বাণিজ্যের মতো বাস্তব বিষয়গুলোতে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এটা ইরানের জন্য এক ধরনের কৌশলগত সম্পর্ক। তিনটি দেশই এখন চাচ্ছে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে। ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে তারা কাদের দিকে ঝুঁকবে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা