শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ভগ্নাংশকে লইয়া কখনো জাতীয় ঐক্য হয় না

আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ০৬:০০

তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের প্রধান সমস্যা হইল জাতীয় অনৈক্য। এই সকল দেশ স্বাধীনতা অর্জনের সময় ঐক্যবদ্ধ হইয়া লড়াই-সংগ্রাম করিলেও স্বাধীনতা অর্জনের পর আর সেই ঐক্য ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। ইহাতে তাহাদের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হইতেছে। একটি দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলমত-পথের লোক থাকিবে-ইহাই স্বাভাবিক; কিন্তু জাতীয় কিছু সাধারণ ইস্যুতে সেই দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ না থাকিলে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না।

এই সকল দেশে স্বাধীনতা অর্জনের সময় জাতীয় ঐক্য তৈরি করিবার অপূর্ব সুযোগ আসে; কিন্তু প্রথমেই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির কথা বলিয়া বিভাজন তৈরি করা হয়। যাহারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যায়-অপরাধ করিয়াছে, গুম, খুন, ধর্ষণসহ গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হইয়াছে, তাহাদের প্রচলিত আইনেই শাস্তি দিয়া ও ট্রুথ কমিশন গঠন করিয়া বিবাদবিসংবাদের সুষ্ঠু ও সহজ সমাধান করা যাইত; কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হয় নাই। ইহার পর বিভিন্ন গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্য গঠনের বারংবার সুযোগ আসিলেও সেই সকল দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেন নাই।

এই সকল দেশে মাঝেমধ্যে জাতীয় ঐক্য গঠনের কথা যে বলা হয় না, তাহা নহে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শেষপর্যন্ত ঐক্য তৈরি হয় ভগ্নাংশকে লইয়া। ইহাতে অনেক সময় অর্ধেক বা প্রায় অর্ধেক জনগণকে ঐক্যপ্রক্রিয়ার বাহিরে রাখিয়াই পথচলা শুরু হয়। ফলে কিছুদিন না যাইতেই আবার অস্থিরতা, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি দেখা দেয়। ইহাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর সুদূর পরাহত হইয়া যায় এবং এই সকল দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র স্থবিরতা চলিয়া আসে। তখন আবার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন-সংগ্রাম বা রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এইভাবে ইহার পুনরাবৃত্তি চলিতে থাকে এবং এই সকল দেশ শেষপর্যন্ত অস্থিরতার চক্র হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারে না বলিয়া বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারে না। এই জন্য আমরা এই সকল দেশে জাতীয় ঐক্য গঠনকে এত তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া মনে করি; কিন্তু কে শোনে কাহার কথা? ফলে আবার যেইকার সেই পরিস্থিতি বিরাজ করে এবং গুণগত পরিবর্তন সাধন ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কঠিন হইয়া পড়ে।

এই সকল দেশ আসলে চলিতেছে হাফ ইঞ্জিন লইয়া। অথচ তাহারা বলিতেছে, ফুল ইঞ্জিনের কথা। ফলে পরিণতি যাহা হইবার তাহাই হইতেছে। উড্ডয়নের সময় বা মাঝপথে বিমান বিকল বা বিধ্বস্ত হইবার ন্যায় দেশ পড়িতেছে গ্যাঁড়াকলে। জাতীয় ঐক্য গঠন করিতে হইলে উদার গণতন্ত্র অনুসরণের কোনো বিকল্প নাই; কিন্তু এই সকল দেশে যখন বিপক্ষ শক্তির লোকজনকে নির্মূল-মূলোৎপাটন বা গৃহছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া করিবার কথা বলা হয়, তখন জাতীয় ঐক্য কীভাবে গঠিত হইবে? এই সকল শব্দ তো লিবারেল ডেমোক্রেসি বা উদার গণতন্ত্রের ডিকশনারিতে নাই। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলিব আর বাস্তবে বামপন্থি বা উগ্রপন্থিদের মতো আচরণ করিব-এই দ্বিমুখিতা লইয়া আর যাহাই হউক, জাতীয় ঐক্য গঠন করা যায় না।

আমাদের মূল কথা হইল ভগ্নাংশ ভগ্নাংশই। ইহাকে যতক্ষণ না জোড়া দিয়া পূর্ণতার দিকে লইয়া যাওয়া হইতেছে, ততক্ষণ জাতি এক হইতে পারে না। ইহার জন্য অবশ্যই সমঝোতা-সংলাপ-সংবেদনশীলতা-সহমর্মিতা ইত্যাদির প্রয়োজন রহিয়াছে। সবচাইতে বড় কথা হইল, কোনো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইলে প্রয়োজন স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কের। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে বহু লিডার বা নেতা রহিয়াছে। তবে শুধু নেতা থাকিলেই হয় না, রাষ্ট্রনায়কও থাকা দরকার যিনি ব্যক্তি, দলীয় ও গোষ্ঠীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া দেশ ও দশের জন্য একান্তভাবে চিন্তা করিবেন। তাহাদের মঙ্গলের জন্য নিরন্তর কাজ করিবেন; কিন্তু এই সকল দেশে সেই রাষ্ট্রনায়ক কোথায়?

ইত্তেফাক/এএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন