শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

স্থবিরতার জগদ্দল পাথর কে সরাইবে?

আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ০৬:৩৬

অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় দেশ আমাদের, উর্বরতায় পূর্ণ এবং তারুণ্যে ভরপুর। অপার সম্ভাবনার এই দেশটি যেন বারুদের মতো জুলিয়া পুনরায় যেন মিলাইয়া যায়। দেখা যায় বিবিধ অব্যবস্থাপনা, স্থবিরতা। বর্ষা মৌসুমের শুরু হইতেই বারংবার যে বাস্তবতার সম্মুখীন হইতেছি, তাহা কেবল প্রকৃতির রুদ্ররূপ নহে, বরং তাহা নিজেদেরই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সামষ্টিক অদক্ষতা। এই বৎসরের ডেঙ্গু পরিস্থিতিও পূর্ববর্তী সময়গুলির ন্যায় উদ্বেগজনক। রাজধানীসহ সমগ্র দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লাফাইয়া লাফাইয়া বাড়িতেছে। অণুজীব বাহিত একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগে প্রতি বৎসর শত শত প্রাণ হারানো কেবল স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতাই নহে, বরং তাহা সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রের শৈথিল্যের দলিল। প্রশ্ন উঠে-সমগ্র বৎসর ধরিয়া যেইখানে পূর্বাভাস ছিল, সেইখানে কার্যকরী ব্যবস্থা কেন লওয়া হয় না? আমাদের দেশটি ভাটির দেশ। ফলে প্রতি বৎসরের বর্ষা আমাদের নিকট অনিবার্য দুর্যোগ লইয়া আসে। একদিকে জলাবদ্ধতা, বন্যা, ঘরবাড়ি ভাঙিয়া যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা তো রহিয়াছেই, জনস্বাস্থ্যও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। গত বৎসর সেপ্টেম্বরে যেই ভয়াল বন্যা ঘটিয়াছিল, তাহা হাজার হাজার মানুষের জীবনে নূতন সংকটের সৃষ্টি করিয়াছিল। অথচ তাহার পূর্ণ প্রস্তুতি বা পরবর্তী পুনর্বাসনের মধ্যে ছিল হাজারো অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পনার ছাপ। ইহার পাশাপাশি আমরা দেখিতেছি অপ্রশিক্ষিত জনবল, অনিয়ম, দপ্তরগুলির মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং সর্বোপরি দায়িত্ব এড়াইবার সংস্কৃতি।

দুর্যোগের সময় কেবল প্রকৃতি নহে, বার্থ প্রশাসনও দুর্ভোগ বাড়াইয়া তোলে। এই দৃষ্টিকোণ হইতে বর্তমান সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হইল-স্থবিরতা। বৈষম্য নিরসন ও জনদুর্ভোগ লাঘবের মানসে দেশে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিলেও, ইহার ফলাফল এখনো প্রকৃত অর্থে সাধারণ নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিফলিত হয় নাই। পূর্বতন শাসনের সমালোচনা ও নিন্দা চলিতেছে ঠিকই; কিন্তু সমান্তরালভাবে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে আশা জাগানিয়া কোনো আগ্রগতি দেখা যাইতেছে না। জনসেবামূলক খাত-স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কব্যবস্থা, দুর্যোগ মোকাবিলা-সকল স্থানেই যেন এক অবর্ণনীয় স্থবিরতা।
স্থবিরতা কখনো কেবল দাপ্তরিক জটিলতা নহে, ইহা জাতির অগ্রগতির অন্তরায়। একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে-'স্থবির জল পচে, চলমান জলই বাঁচায়।' যেই সমাজের পদে পদে স্থবিরতা গ্রাস করে, সেই সমাজ একদিন নিজের ভারেই ধসিয়া পড়ে। প্রবাদ তাহাই বলে। বিশেষত এই সময়ে, যখন দেশে একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যাশিত ছিল আরো কর্মতৎপর হইবে, আরো উদ্যোগী হইবে জনকল্যাণে; কিন্তু বরং ভিন্ন চিত্রই উন্মোচিত হইতেছে-উদ্দেশ্যহীন দৌড়ঝাঁপ, অপরিকল্পিত উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে ভুগিতেছে প্রশাসন। এমনকি মশক নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন কিংবা নূতন করে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়িয়া তোলার ক্ষেত্রেও নাই কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি।

আমাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি, সমন্বয় এবং সুনির্দিষ্ট কর্তব্যবোধ। প্রতিটি দুর্যোগ একটি সতর্কবার্তা-পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকিবার; কিন্তু আমাদের দুঃখজনক পরিণতি হইল, প্রতিবারই এ কী পরিণতি, এ কী হাহাকার। যদি আমরা এই স্থবিরতাকে অতিক্রম করিতে না পারি, তাহা হইলে কেবল স্বাস্থ্য খাতই নহে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নই হইবে প্রশ্নবিদ্ধ। যদি প্রতি বর্ষায় ডেঙ্গুতে প্রাণ যায়, যদি বন্যায় গ্রাম তাসে, যদি বিবিধ স্থবিরতার জগদ্দল পাথর জনগণের বুকে চাপিয়া বসে, তখন সেই দমবন্ধ পরিস্থিতি জনগণ কখনো দিনের পর দিন সহ্য করে না। স্থবিরতার জগদ্দল পাথর সরাইতে জনগণ তখন মরিয়া হইয়া উঠে। ইতিহাস অন্তত তাহারই সাক্ষ্য দেয়। বাগাড়ম্বর নহে, বরং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনই হউক এই সময়ের অঙ্গীকার। কথায় বড় না হইয়া কাজে বড় হইতে হইবে। যাহারা কর্মবীর তাহারা কম কথা বলিয়া থাকেন।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন