মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস ২০২৫

যেভাবে বদলে যাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন

আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ১০:০৩

‘কখনও ভাবিনি, এই বয়সে এসে নতুন কিছু শিখবো, সেখান থেকে উপার্জনও করবো’। কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাঁশ আর ত্রিপলে বানানো ঘরে বসে মাছ ধরার জাল বুনতে বুনতে কথাগুলো বলছিলেন ৫৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী সখিনা আক্তার।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতের আঙ্গুলের বুনন যেন তার চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলছিল আত্মবিশ্বাস আর মাতৃভূমিতে ফেরার স্বপ্নকে।

এত দিন নানা সংস্থা আর সরকারের সহায়তার উপর নির্ভরশীল থাকলেও, সম্প্রতি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) এর সহায়তায় জীবিকা অর্জনের জন্য নতুন এই কাজ শিখেছেন সখিনা।

তিনি এখন নিজেই জাল তৈরি করেন এবং ক্যাম্পের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে উপার্জন করছেন। 

শুধু সখিনা একা নয়। তার মতো আরও অনেকেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন, নতুন করে সম্মান আর আশার ভেলায় চড়ে জীবন গড়তে চাইছেন। লক্ষ্য একটাই, দক্ষ হয়ে ঘরে ফেরা; মাতৃভূমিতে ফেরা।

জাল বোনার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অনেকেই নানান প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন ধরণের দক্ষতা অর্জন করেছেন যেমন, সেলাই, সেলুন বা নাপিতের কাজ, সবজি বাগান, পাইপ ফিটিং ও টিউবওয়েল মিস্ত্রীর কাজ, হাঁস-মুরগী পালন ইত্যাদি।

এই উদ্যোগগুলো এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে, তাদের সম্মান ও নিজের প্রতি নির্ভরতা ফিরে পেতে সাহায্য করছে।

ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আরেক রোহিঙ্গা নারী রহিমা (২৮) বলেন, ‘আগে আমি সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার উপরই নির্ভর করতাম। এখন নিজে সেলাইয়ের কাজ করছি, কিছু উপার্জন করছি। এগুলো আমার সংসার ও বাচ্চাদের জন্য কাজে লাগছে। দেশে ফিরে যাওয়ার পর এই শিক্ষাগুলো আমার কাজে লাগবে।’

উখিয়ার ১১ নম্বর ক্যাম্পের জাহিদের ভাষায়, ‘যখন উপার্জন করি, মনে হয় আমি বেঁচে আছি। অথচ আগে শুধু ঘরে বসে থাকতাম। এখন জীবনটা অর্থবহ মনে হয়, নিজেকে সম্মানিত মনে হয়।’

যেখানে মনের কথা বলতে নেই মানা

কক্সবাজারের তিনটি ক্যাম্পে রেড ক্রিসেন্টের ‘Dignity, Access, Participation and Safety (DAPS)’- বা মাল্টিপারপাজ সেন্টার রয়েছে যা ওই ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের প্রাণকেন্দ্র।

এখানে নারী, শিশু, পুরুষ, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীসহ যেকোনো বয়সের মানুষ সমানভাবে অংশ নিতে পারে। মন খুলে নিজেদের কথা বলতে পারেন।

তারা এখানে এক সঙ্গে শেখে, কথা বলে, মিয়ানমারে ফেলে আসা স্মৃতি, জীবন ও পরিবার নিয়ে। স্বপ্ন দেখে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার, নতুন করে জীবন গড়ার।

এসবের পাশাপাশি এই সেন্টারগুলো আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়; বিশেষ করে রেড ক্রিসেন্টের কাজের ব্যাপারে যেকোনো ধরণের অভিযোগ ও মতামত জানানো ও বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া নিয়ে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, মানবপাচার রোধ, জীবন-দক্ষতা, মানসিক সহায়তা, অধিকার নিয়ে নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

সেন্টারের একজন স্বেচ্ছাসেবক জমিলা বেগম। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কখনও ভাবিনি আমাদের কথাও গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে। আগে আমাদের জিজ্ঞেস না করেই সবকিছু ঠিক হতো, এখন আমাদের সাথে পরামর্শ করা হয়। এখন মনে হয় আমাদেরও মূল্য রয়েছে।’

দুর্যোগ সহনশীলতা, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা প্রায়ই অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিধ্বসের মতো ঘটনা ক্যাম্পে ঘটে। এছাড়াও ভারি বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঝড় ও বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত দুর্যোগ তো রয়েছেই। এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা যেমন জরুরি তেমনই জরুরি সঠিক ও দ্রুত দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা।  

তাই এসব ক্ষেত্রে সরকার ও মানবিক সংগঠনগুলো আগের চাইতেও বেশি জোর দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য দুর্যোগ সহনশীল ঘর নির্মাণ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে অতীতের চাইতে আরও বেশি প্রস্তুত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের সদস্যরা এখন জানে ঝড় এলে, আগুন কী করতে হবে এবং কোথায় যেতে
হবে।

এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা যখন সঠিক প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে, কক্সবাজার ক্যাম্পে শেখানো বিভিন্ন উন্নয়ন দক্ষতামূলক কাজগুলো তাদের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

কারণ ক্যাম্পে দেওয়া মানবিক সহায়তা শুধু তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলতেও কাজে আসছে।

কক্সবাজার ক্যাম্পের রহিমা, জাহিদ কিংবা সখিনারা যেন সারা বিশ্বের বাস্তুচ্যুত মানুষের কণ্ঠ। যারা ঘরে ফেরার আশা হারায় না, একদিন না একদিন নিজ দেশে ফেরার বিশ্বাসে বেঁচে থাকে। এ এমন এক বিশ্বাস, এমন আশা যা আমরা অবহেলা করতে পারি না, বিশ্ববাসী কেউই অবহেলা করতে পারে না।

আমরা চাই, পৃথিবীর সকল বাস্তুচ্যুত শরণার্থীরা নিরাপদে ঘরে ফিরুক।

ইত্তেফাক/এপি