তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, প্রশাসন চলে ক্ষমতাসীন বা যাহারা নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করেন, এমন সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হুকুমমতো। প্রশ্ন হইল, প্রশাসন তাহাদের কথা অনুযায়ী চলিবে কেন? প্রশাসন চলিবে প্রশাসনের মতো। বিষয়টি ব্যাখ্যাযোগ্য বটে।
এইখানে সম্পূরক প্রশ্ন হইল, প্রশাসন কাহাদের দ্বারা চলিবে? অনেক সময় বলা হয় প্রশাসনের লোকজন আগের সরকারের সমর্থক। কিন্তু এইভাবে সবকিছুকে সরলীকরণ করা যায় না। কেননা মুখে ভালো ভালো কথা বলা আর মাঠে-ময়দানে কাজ করা এক জিনিস নহে। সরকারের কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করিতে হইলে প্রশাসন দ্বারাই করিতে হইবে। একটি দেশের প্রধান নির্বাহী সাবঅর্ডিনেটস বা অধীনস্থদের দ্বারাই দেশ পরিচালনা করিয়া থাকেন। এই সাবঅর্ডিনেটস হইল প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী। যদি তাহাদের পূর্ববর্তী সরকারের লোক বলিয়া ধরা হয়, তাহা হইলে পালটা এমন প্রশ্নও উঠিতে পারে, তাহা হইলে তাহাদের লোক কোথায়? আসলে আমলা বা প্রশাসনের লোকেরা কাহারো লোক হইবার কথা নহে। তাহারা প্রজাতন্ত্রের লোক। আবার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাহারো জমিদারি বা তালুকদারি মনে করিবারও কোনো অবকাশ নাই। তাই প্রশাসন চলিবে জনগণের প্রতিনিধি বা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা নিয়মকানুনের মধ্যে থাকিয়া। কিন্তু মাসের পর মাস যদি কোনো রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সৃষ্টি না হয়, তাহা হইলে কী হইবে? ইহাতে স্বাভাবিকভাবে সেই দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হইবে।
প্রশাসনিক লোকেরা সর্বক্ষণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হুকুমমতো চলিবে, এমনটি আশা করা অবাস্তব। এমনটি হইলে সেই প্রশাসন স্থবির হইয়া পড়িবে। জনগণের স্বার্থে তাহাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করিতে হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রশাসনে যাহারা থাকেন, তাহাদের প্রায়শ বিধিমালার মধ্যে থাকিয়া কাজ করিবার পরিবেশ থাকে না। সরকার আসিবে ও সরকার যাইবে। তবে প্রশাসন প্রশাসনের মতো তাহার কাজ অব্যাহত রাখিবে। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের (১৮৬৪-১৯২০) 'আদর্শ আমলাতন্ত্র' (আইডিয়াল টাইপ অব ব্যুরোক্রেসি) তত্ত্ব অনুযায়ী আমলাতন্ত্রের জন্ম হইয়াছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান জটিলতা, বিশালতা ও কার্যকারিতার প্রয়োজনীয়তা হইতে। ইহা রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারাবাহিকতা (কনটিনিউটি) ও কার্যকারিতার (ইফিসিয়েন্সি) অপরিহার্য উপাদান। তাহাদের দ্বারা রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস বা নিয়মকানুনের অনুসরণ ও ইমপারসোন্যালিটি বা নিরপেক্ষতার কারণে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রে একধরনের চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য ও অ্যাকাউন্টিবিলিটি তথা জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম-নীপিড়ন, নির্বাচন প্রভৃতি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যাহারা ক্ষমতাসীন হন, তাহাদের অধিকাংশই মনে করেন প্রশাসন উঠিতে-বসিতে তাহাদের হুকুম তামিল করিবে। কিন্তু সংবিধান বা রুলস অব বিজনেসে এমন কথা লিখা নাই। বরং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সহিত প্রশাসনিক লোকজনের মতবিরোধ বা মতভেদ হয় বা হইতে পারে। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশে অনেকে এমন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসেন যে, তাহা গবেষণা করিয়া শেষ করিতে এক দশকও লাগিয়া যাইতে পারে। তাহাদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা ইত্যাদির অভাব দেখা দিলে প্রশাসনের লোকজন কি তাহাও মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকিবেন?
আমরা জানি, একটি দেশের সংবিধানে তিনটি বিভাগ থাকে। নির্বাহী (এক্সিকিউটিভ), আইন (লেজিসলেটিভ) ও বিচার (জুডিশিয়ারি) বিভাগ। ইহার পরই গণমাধ্যমকে ফোর্থ স্টেট বা চতুর্থ বিভাগ হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হইল, নির্বাহী বিভাগে যাহারা আছেন তাহাদের কথামতোই যদি সবকিছু চলিতে থাকে, তাহা হইলে বাকি বিভাগগুলি থাকিবার দরকার কী? দরকার এই জন্য, যাহাতে তাহাদের নিজেদের বিভাগও ঠিকমতো চলে। নতুবা নিজেদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাজ্য দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক নহে। অতএব, উন্নয়নশীল দেশের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সব পাইয়াছি এমন মনোভাবের অবসান হওয়া দরকার। প্রশাসন দ্বারা নিজেদের ইচ্ছামতো সব কাজ যেমন সম্পাদন করা যায় না, তেমনি ভয় দেখাইয়াও চলিতে পারে না কোনো রাষ্ট্র। ইহা হইতে শিক্ষা গ্রহণ না করিলে এই সব দেশ যেই তিমিরে আছে সেই তিমিরেই যে থাকিয়া যাইবে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।