সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিপিএস) সার্ভারে অবৈধভাবে প্রবেশ করে মাত্র ১৭ মিনিটে একটি বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজউকের সার্ভার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্ন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির সার্ভার এত সহজে হ্যাকারদের কবলে পড়ায় উদ্বেগ জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভাষ্য, এ ঘটনা শুধু একটি ভবনের অনুমোদন জালিয়াতির বিষয় নয়, রাজউকের সার্ভারের সার্বিক নিরাপত্তা দুর্বলতারও প্রমাণ। রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক হওয়া মানে শুধুই অননুমোদিত ভবন নয়, নগরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়া। এর মাধ্যমে কোনো দুর্বৃত্তচক্র চাইলে নগরের জোনিং, ভবন নকশা, রাস্তাঘাট পরিকল্পনা এমনকি নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকার তথ্য চুরি করে নিতে পারে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউকের ডিজিটালাইজেশন ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এই ধরনের স্পর্শকাতর কাজ ই-গভর্ন্যান্সের জন্য হুমকি। শুধু ভবন অনুমোদন নয়, এই পোর্টালে আছে নগর ভবনের ডেটাবেস, মানচিত্র, স্থাপত্য নকশা, এমনকি সেনসেটিভ সরকারি ভবনের নকশাও।
এদিকে রাজউক সূত্র বলছে, অবৈধভাবে অনুমতি নেওয়া এই ভবনটি ছিল জলাভূমি ও উচ্চতা নিষেধাজ্ঞার আওতায়, ফলে অনুমোদনটি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার রাজউকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ ও প্রটোকল) মো. আব্দুল্লাহ আল মারুফ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
তবে এ ঘটনায় রাজউক বলছে, এটি তাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি করেছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সার্ভার বিগত সময়ে হ্যাক হওয়ার অভিযোগ আছে। গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থার সার্ভার হ্যাকের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—এমন নজির নেই। জনসাধারণের একাংশের মনে করেন রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণেই হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে, এই বিষয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষ কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য বা ব্যাখ্যা দেয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ঘটনার সূত্রপাত ১৯ মে, রাজউকের নজরে আসে মাত্র ১৭ মিনিটে একটি ভবনের নকশা অনুমোদনের ঘটনা। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হলে সার্ভার বন্ধ করে তদন্ত শুরু করে রাজউক। পরে জানা যায়- একই পদ্ধতিতে আরও তিনটি নকশা অনুমোদনের চেষ্টাও চলছিল। এরপরই বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে রাজউক কর্তৃপক্ষ। তদন্তে দেখা যায়, এসব জাল নকশায় ‘রাবেয়া বারী’ নামের এক প্রকৌশলীর স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর উঠে আসে মতিঝিল এলাকার ‘নীল নকশা’ নামের একটি কম্পিউটার দোকানের নাম। দোকানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনামুল, স্বপন ও অন্য কর্মীদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে সার্ভারে প্রবেশ করে ভবন অনুমোদনের অভিযোগ পাওয়া যায়।
রাজউকের মোবাইল কোর্ট ওই দোকানে অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, দোকানের কম্পিউটারে অবৈধভাবে তৈরি করা নকশাগুলোর কপি রয়েছে এবং রাজউকের নির্ধারিত ফি পরিশোধে দোকানমালিকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে চলতি মাসের ৬ জুন রাজউক বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ২১, ২২ ও ২৪ নম্বর আসামি হিসেবে ‘নীলাভ নকশাঘর’-এর মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও তার সহযোগী সজীব ও শিমুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
সূত্র মতে, রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলামের নির্দেশনায় সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ধারাসহ দণ্ডবিধির ধারায় উত্তরা পূর্ব থানায় মামলাটি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে উত্তরা পূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এ ঘটনায় ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
এ বিষয়ে জানতে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলামকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রন) মোহা. হারুন-অর-রশীদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘ঘটনার পরই আমরা সার্ভার বন্ধ এবং থানায় একটি মামলা করা হয়। ইতোমধ্যে তিনজন আটকও হয়েছেন। এছাড়া এ ধরণের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।