নিকট অতীতে বাংলাদেশে অবস্থানের সময় এক বিদেশি কূটনীতিক বাংলাদেশের অগ্রগতির গল্প শুনিয়া বলিয়াছিলেন, 'যেই দেশে মানুষ মানুষকে টানে (রিকশা চালকরা প্যাডেল চালাইয়া যাত্রী বহন করে), সেই দেশের উন্নয়ন কখনই প্রকৃত উন্নয়ন হইতে পারে না।' হয়তো এখন আর অসংখ্য রিকশাচালককে পায়ে প্যাডেল দিয়া মানুষ টানিতে হয় না; ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাইয়া কায়িক শ্রম কিছুটা লাঘব করিতে পারেন, তবে এখনো অসংখ্য পায়ে চালানো রিকশা রহিয়াছে। এবং বাস্তবিক কারণেই তাহা আমাদের দেশ হইতে সহজে বিদায় লইবে না: কিন্তু মুশকিল হইল, ব্যাটারিচালিত রিকশার কিছু নিয়মকানুন রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া পায়ে টানা রিকশায় একটি ব্যাটারিচালিত মোটর লাগাইয়া তাহা সড়কে নামানো যায় না। কারণ, উহার ইঞ্জিয়ারিং অবকাঠামো যেই গতির জন্য তৈয়ারি, ব্যাটারিচালিত রিকশা তাহার চাইতে অনেক অধিক গতিতে চলে। এবং এইখানেই যত বিপদ। তাহা ছাড়া, এই যানবাহনের সীমিত গতি ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা কখনোই তাহাকে মহাসড়কে চলাচলের উপযুক্ত করিয়া তোলে না।
বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকিলেও তিন চাকার ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে উলটা পথে যেইভাবে চলাচল করিতেছে, তাহা নিতান্ত উদ্বেগজনক। বিশেষত সাইনবোর্ড হইতে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত মহাসড়কের দুই ধারে যেইভাবে এই যানবাহন দাপটের সহিত চলাচল করিতেছে, তাহাতে একদিকে সৃষ্টি হইতেছে যানজট ও বিশৃঙ্খলা, অপরদিকে ঘটিতেছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গত ছয় মাসে এইরূপ উলটাপথে চলাচলের কারণে অর্ধশতাধিক প্রাণহানি ঘটিয়াছে। তথাপি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের টনক নড়িতেছে বলিয়া মনে হয় না। হাইওয়ে পুলিশের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে উলটা পথে এই যানবাহন চলিলেও কার্যকর প্রতিকার লক্ষ করা যাইতেছে না। যদিও পুলিশ সূত্রে দাবি করা হইতেছে যে, প্রতিদিন অভিযান পরিচালিত হইতেছে, অনেক যানবাহন জব্দ ও জরিমানাও করা হইতেছে, তথাপি বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপ নিছকই আনুষ্ঠানিকতা বলিয়া প্রতীয়মান হয়। কয়েক মাস পূর্বে সংঘটিত কাঁচপুর ব্রিজের ঢালের দুর্ঘটনাটি ছিল হৃদয়বিদারক। এক গৃহবধূ, তাহার সন্তান ও একজন অটোচালক মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারাইলেন। অথচ এই দুর্ঘটনার পরও পরিবর্তন ঘটিল না রিকশাচালকদের আচরণে, পুলিশের কার্যকরতায় কিংবা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
পথচারী, যাত্রী এবং অন্যান্য বৈধ যানবাহনের চালকদের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করিয়া প্রমাণ করে যে, ব্যাটারিচালিত এই তিন চাকার যান মহাসড়কে চলাচল করিবার জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। ইহারা মহাসড়কে চলিতে গিয়া বড় যানবাহনের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, বহু ক্ষেত্রে হঠাৎ সামনে পড়িয়া দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহারা উলটা পথে চলিয়া শুধু নিজেদের নয়, অপরাপর যাত্রী ও পথচারীদের জীবনও ঝুঁকির মুখে ঠেলিয়া দেয়। ব্যাটারিচালিত যানবাহনগুলির চালকগণ অনেক সময় পুলিশকে 'ম্যানেজ' করিয়া চলাচল করেন বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে। এই অটোরিকশাগুলির জন্য যদি সত্যিই বিকল্প রোড বা লেন গঠনের প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে তাহা নির্মাণের জন্য অর্থনৈতিক সক্ষমতা বা পরিকল্পনা প্রয়োজন। অতএব, বর্তমান পরিসরে যাহা প্রয়োজন তাহা হইল-নিয়ম কঠোরভাবে মানা এবং মানানো। উন্নত ডিজাইনে নির্মিত কোনো নূতন প্রজন্মের ব্যাটারিচালিত যান ভবিষ্যতে হয়তো মহাসড়কে চলাচলের জন্য উপযোগী হইতে পারে; কিন্তু তাহার জন্যও প্রয়োজনীয় গবেষণা, পরীক্ষানিরীক্ষা, লাইসেন্সিং ও পৃথক গতি-নির্ধারণ আবশ্যক।
সর্বোপরি, সুশাসনের প্রধান ভিত্তি হইতেছে 'নিয়ম'। যেই রাষ্ট্র নিয়ম লঙ্ঘনের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়, তাহা আত্মঘাতী প্রবণতার পথেই অগ্রসর হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, উন্নয়ন কেবল রাস্তা, সেতু, অট্টালিকা নির্মাণের মাধ্যমে হয় না। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন নাগরিকদের মধ্যে আইন মানার অভ্যাস, নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অপরের জীবনের মূল্যবোধ গড়ে উঠে। ব্যাটারিচালিত রিকশার চালককে হয়তো তাহার যাত্রীকে এখন আর টানিয়া লইয়া যাইতে হইতেছে না; কিন্তু নিয়মকে এইভাবে টানিয়া টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলে আমরা কোনো অর্থবোধক গন্তব্যে পৌঁছাইতে পারিব না।