দেশে আবারও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাইতেছে। ইহা আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন করিয়া উদ্বেগ সৃষ্টি করিয়াছে। গত আড়াই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হইতেছে না। মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে মাস্ক পরা কিংবা অফিস-আদালতে হ্যান্ড স্যানিটাইজেশন ব্যবহারেও একপ্রকার অনীহা দেখা যাইতেছে। কোথাও কোথাও স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হইয়াছে বটে, তবে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার-প্রচারণার অভাবে এখনো এই ব্যাপারে তেমন কোনো সাড়া পড়ে নাই। তাহার উপর টিকা গ্রহণে অনীহার কথা শুনিয়া আমরা প্রমাদ গুনিতেছি। আমাদের এই উদাসীনতা শুধু নতুন সংক্রমণের ঝুঁকিই বাড়াইতেছে না, বরং সরকারের মজুতকৃত লাখ লাখ ডোজ টিকা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করিতেছে।
অবশ্য মানুষের টিকা গ্রহণে অনীহার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, দীর্ঘ সময় ধরিয়া সংক্রমণের নিম্নহারের কারণে মানুষের মধ্যে 'করোনাভীতি' কমিয়া গিয়াছে। একসময় যে ভয় ও সচেতনতা ছিল, তাহা এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, টিকাদান কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা। সমগ্র দেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি কেন্দ্রে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে, যাহা সাধারণ মানুষের জন্য টিকাপ্রাপ্তি কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। তৃতীয়ত 'সুরক্ষা' অ্যাপের অকার্যকারিতা টিকা গ্রহণের তথ্য সংগ্রহ এবং মানুষকে উৎসাহিত করিবার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করিতেছে। চতুর্থত কিছু মানুষের মধ্যে মজুতকৃত টিকার কার্যকারিতা বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া লইয়া ভুল ধারণা বা সংশয় থাকিতে পারে, যদিও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ইহার কার্যকারিতা নিশ্চিত করিয়াছেন।
টিকা নিতে মানুষের অনীহার সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ প্রভাব রহিয়াছে। সবচাইতে প্রত্যক্ষ প্রভাব হইল সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী একদিনে তথা ২৪ ঘণ্টায় করোনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হইয়াছে। শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রাথমিক পর্যায়ে এই হারও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি এই প্রবণতা চলিতে থাকে, তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর চাপ বাড়িতে থাকিবে এবং জনজীবন আবার ঝুঁকির মুখে নিপতিত হইবে। জানা মতে, প্রায় ৩২ লাখ ডোজ টিকা রহিয়াছে। যাহার মধ্যে ১৭ লাখ ফাইজারের টিকা। এই ফাইজারের টিকার মেয়াদ দ্রুত শেষ হইতে চলিয়াছে বিধায় এখনই ইহার সদ্ব্যবহার প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, টিকাদানের ধীরগতি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর রোগপ্রতিরোধক্ষমতাকে দুর্বল করিয়া দিতে পারে। ইহা নূতন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব বা দ্রুত বিস্তারের জন্য তৈরি করিতে পারে অনুকূল পরিবেশ।
তাই এই জনস্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রথমত মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার আগ্রহ বাড়াইতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাইতে হইবে। টিকার উপকারিতা, কার্যকারিতা এবং মেয়াদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়া মানুষের ভুল ধারণা ভাঙাইতে হইবে। দ্বিতীয়ত টিকাদান কেন্দ্রগুলো বাড়ানো এবং সেগুলোকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় লইয়া যাইতে হইবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। তৃতীয়ত অন্তঃসত্ত্বা নারী, বয়স্ক ব্যক্তি, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা নিতে উৎসাহিত করিতে হইবে। তাহাদের জন্য বিশেষ টিকাদান কর্মসূচির আয়োজন করা যাইতে পারে। চতুর্থত টিকা কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ ও মানুষকে সহজভাবে টিকা প্রাপ্তির সুযোগ দিতে সুরক্ষা অ্যাপটি দ্রুত সচল করা জরুরি। তবে সকলের পূর্বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য টিকা প্রয়োগে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হইবে, কারণ তাহাদের সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসিতে হয়। তাহারা হইলেন করোনা মোকাবিলায় প্রথম সারির যোদ্ধা।
করোনা ভাইরাস একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। টিকা গ্রহণ কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষাই নহে, বরং একটি সুস্থ ও সুরক্ষিত সমাজের ভিত্তি। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপই পারে এই ঝুঁকি হইতে জাতিকে রক্ষা করিতে। আমাদের মনে রাখিতে হইবে, যে কোনো মহামারি মোকাবিলায় উদাসীনতা নহে, বরং সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতাই প্রধান দাওয়াই।