শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

কঙ্গো-রুয়ান্ডায় আসিয়াছে নূতন ভোর

আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ০৭:০০

দীর্ঘ ৩০ বৎসরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাইয়া সম্প্রতি মধ্য আফ্রিকার দুই প্রতিবেশী দেশ কঙ্গো ও রুয়ান্ডা একটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে উপনীত হইয়াছে। এই চুক্তির প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতায় এই আলোচনার সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব হইয়াছে। শান্তির পথে এই পদক্ষেপ কেবল আফ্রিকার দুই রাষ্ট্রের জন্য নহে, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত নিঃসেন্দেহে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলিয়াছেন যে, আজিকার দিনটি এক নূতন ভোর। সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটাইয়া এই অঞ্চল আশার, সমৃদ্ধির ও শান্তির নূতন অধ্যায়ে প্রবেশ করিতেছে।

ট্রাম্পের এই বক্তব্য নিছক আনুষ্ঠানিক নহে, বরং এক সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক বাস্তবতা এবং ভূরাজনৈতিক নীতিরই প্রতিফলন। কারণ, ১৯৯০-এর দশক হইতে কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চল, বিশেষত পূর্ব কঙ্গোর নিয়ন্ত্রণ, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির কার্যক্রম এবং ঐ অঞ্চলের বিপুল খনিজ সম্পদকে কেন্দ্র করিয়া যে সংঘাত চলমান ছিল, তাহা প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জীবন কাড়িয়াছে। শতাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে এম-২৩ অন্যতম, যাহাদের প্রতি রুয়ান্ডার সমর্থনের অভিযোগ বহুদিন ধরিয়াই আলোচিত। শান্তিচুক্তির অন্যতম সীমাবদ্ধতা হইল, এম-২৩ সরাসরি এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নহে, যদিও উহা এক বৃহত্তর শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ বলিয়াই ধরা হইতেছে। চুক্তিতে যাহা অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে তাহা হইল-সীমান্ত অখণ্ডতার স্বীকৃতি, যুদ্ধবিরোধ ঘোষণা, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির নিরস্ত্রীকরণ এবং শর্তসাপেক্ষে তাহাদের পুনঃসমন্বয়ের নীতিমালা। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেস কায়িকওয়াম্বা ও রুয়ান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলিভিয়ে এনডুহুংগিরেহে। তাহারা উভয়েই বাস্তবতার জটিলতা স্বীকার করিয়া বলেন-সকল ক্ষত একদিনে সারিবে না, তবে শান্তির পথে একটি নূতন যাত্রা শুরু হইল।

এই চুক্তির পেছনে কাতার সরকারের নিরলস পরিশ্রমের কথাও স্মরণযোগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাতার কূটনৈতিক সমন্বয়ে যে চমৎকার ভূমিকা রাখিয়াছে, তাহা এই চুক্তিকে এক আঞ্চলিক ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে লইয়া গিয়াছে। আজ যখন যুদ্ধের উত্তাপ বিশ্বব্যাপী ছড়াইয়া পড়িতেছে, তখন এমন শান্তিচুক্তি নিঃসন্দেহে এক আশার বাতিঘর।

মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, কঙ্গোর ভূগর্ভস্থ সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। অতএব, ট্রাম্প প্রশাসন যদি শান্তির মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলে মার্কিন কোম্পানিগুলির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে, তাহা হইলে উহা কূটনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি একটি কৌশলগত বিজয়ও হইয়া দাঁড়াইবে বলিয়া অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ইহার পাশাপাশি এই সত্যও অনস্বীকার্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিতে যেইভাবে ন্যায়, বাস্তবতা ও কৌশলের সমন্বয় করিয়াছে, তাহা প্রশংসনীয়। যদিও এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বিপুল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করিতেছে। কঙ্গোর অভ্যন্তরে এখনো বহু বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয়, এম২৩ চুক্তিকে মান্যতা দেয় নাই এবং স্থানীয় জনগণের মনে অবিশ্বাস এখনো যায় নাই। যদিও তাহা রাতারাতি যাইবার নহে। ইতিহাস আমাদের শিখায়-শান্তিচুক্তি কেবল নথিতে থাকিলে চলিবে না, তাহাকে রূপ দিতে হয় ন্যায়বিচার, বিশ্বাস ও অংশগ্রহণমূলক শাসনের মাধ্যমে। ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার পর যেইভাবে অঞ্চলটি বিপর্যস্ত হইয়াছিল এবং তাহা হইতে জন্ম লইয়াছিল এই দীর্ঘ সংঘাত, তাহার স্মৃতি আজও মুছিয়া যায় নাই। অতএব, কূটনীতির পাশাপাশি প্রয়োজন সত্যের মুখোমুখি হইবার সাহস।

এই শান্তিচুক্তি কেবল আফ্রিকার জন্যই নহে, বরং বিশ্বশান্তির পক্ষে এক নূতন বার্তা। শান্তি চাপাইয়া দেওয়া যায় না-তবে সক্রিয় নেতৃত্ব, আন্তরিকতা এবং সুপরিকল্পিত কূটনীতির মাধ্যমে তাহা সম্ভব। এই চুক্তি যদি বাস্তবে কার্যকর হয়, তাহা হইলে ইতিহাস ট্রাম্প প্রশাসনকে এক শান্তিকামী পরাশক্তির উদাহরণ হিসাবেই স্মরণ রাখিবে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন