প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল পূর্বে, নাসা আমাদের মহাবিশ্বে পাঠাইয়াছিল ক্ষুদ্র মহাকাশযান-ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২। উহারা আজ সূর্যের সীমানা অতিক্রম করিয়া প্রবেশ করিয়াছে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে। ১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপিত এই দুইটি প্রোবের বাহনে মানুষ প্রথম পাঠাইয়াছিল এক অমূল্য বার্তা-গোল্ডেন রেকর্ড। পৃথিবীর ভাষা, সংগীত, প্রাণপ্রকৃতি, বৈজ্ঞানিক চিত্র, এমনকি হৃদয়ের অনুভব-সকল কিছুই ধারণ করা হইয়াছে এই একটিমাত্র ধাতব ডিস্কে, সম্ভাব্য কোনো বুদ্ধিমান ভিনগ্রহবাসীর নিকট পৌঁছাইবার আশায়। ভয়েজার প্রোবের অগ্রভাগে যে অ্যালুমিনিয়াম-কপারের ডিস্ক তথা রেকর্ডটি স্থাপন করা হইয়াছে, তাহাতে পৃথিবীর অবস্থান নির্দেশক পালসার মানচিত্র, ফনোগ্রাফ তৈরির চিত্রাবলি ও চলমান নির্দেশাবলি এবং এক শৈল্পিক সৌন্দর্য নিহিত; কিন্তু এই সৌন্দর্য কেবল রূপ বা তথ্যচিত্র নহে-ইহা মানবজাতির পক্ষ হইতে একটি দর্শনগত অভিপ্রায়-'আমরা আছি এবং আমরা জানিতে চাই অন্য কেহ আছে কি না।' কল্পনা করিলে ইহার দার্শনিক দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটি ক্ষুদ্র যন্ত্র, পৃথিবী হইতে এক 'আলোক-দিবস' দূরে অবস্থান করিতেছে, যাহা হাজার হাজার বৎসরের দীর্ঘ পথে চলিতে চলিতে কোনো এক দূর জগতের বুদ্ধিমান প্রাণীর নিকট হয়তো একদিন পৌঁছাইবে; এবং তাহারা শুনিবে-আমাদের ভাষা, আমাদের কণ্ঠ, হাসির শব্দ, শিশুর ধ্বনি, মা ও সন্তানের মেলবন্ধন, বৃষ্টির শব্দ, প্রাণীর ডাক, ক্লাসিক্যাল সংগীত, আদিবাসী মেলোডি, এমনকি এক নারীর প্রেমে পড়িবার মুহূর্তে তাহার মস্তিষ্কের তরঙ্গরূপী শব্দ! তাহারা জানিবে, সুদূর সৌরজগতের তিন নম্বর গ্রহে বাস করে 'মানুষ' নামের এক ধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী।
কিন্তু এইখানেই আসিয়া আমাদের মনের মধ্যে উঁকি মারে এক গভীর প্রশ্ন-মানুষ সত্যিই কি বুদ্ধিমান? এই গোল্ডেন রেকর্ডে যে পৃথিবীর মুখ আমরা দেখাইয়াছি, তাহা নিঃসন্দেহে আশ্চর্য সুন্দর, মনোমুগ্ধকর, মানবিক; কিন্তু এই মানবিক মুখ কি সম্পূর্ণ সত্য? ভয়েজারের ডিস্কে তো স্থান পায় নাই হিরোশিমা-নাগাসাকির কান্না, স্থান পায় নাই কসমিক নীরবতায় হারাইয়া যাওয়া অনাহারে মৃত লক্ষ লক্ষ শিশুর আর্তনাদ। স্থান পায় নাই সেই ইতিহাস, যেইখানে মানুষ নিজেদের জাতিগত পরিচয়ে বিভক্ত হইয়া সহস্র-অযুত যুদ্ধ করিয়াছে? কীভাবে প্রকাশ পাইবে সেই লোভ, যাহার কারণে লক্ষ-কোটি মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, অথচ প্রতি বৎসর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় অস্ত্র কারখানায়?
ভয়েজার মহাশূন্যে চলিতেছে-অবিরত, নির্জন, নিরুদ্দেশের দিকে। তাহার বুকে বহন করিতেছে আমরা কে, আমাদের কণ্ঠ, আমাদের ভাষা, আমাদের হাসি; কিন্তু কী করিয়া জানিবে সেই প্রোব, যে এই গ্রহে মানুষ এখনো পরস্পরের রক্তে পৃথিবীর মাটি রঞ্জিত করে? কী করিয়া বুঝিবে যে গোল্ডেন রেকর্ডের হৃদয়গ্রাহী বার্তার অন্তরালে লুকায় মানবজাতির যুদ্ধ, লোভ, বৈষম্য, ঘৃণার চক্র। ভয়েজারের সোনালি রেকর্ড যেন এক ধ্রুপদী মুখোশ, যাহা মানবজাতিকে দেখায় মহান, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রেমময়; কিন্তু এই মুখোশের অন্তরালে লুকায়িত অন্য এক ভয়ংকর রূপ। একদিকে প্রেম ও মানবিকতা, অন্যদিকে হিংসা ও ধ্বংস-এই দ্বৈততার নামই হয়তো মানুষ। এই রেকর্ড শুনিয়া যদি কোনো এলিয়েন আমাদের সম্পর্কে ধারণা লইতে চাহে-তাহা হইলে তাহারা ভাবিবে, মানুষ কল্পনাতীতভাবে সৃজনশীল, নিখাদ হৃদয়বান, অগ্রসর ও সৌন্দর্যসন্ধানী; কিন্তু তাহারা জানিবে না, পৃথিবীর প্রতি শহরে ক্ষুধার্ত শিশু আছে, গৃহহীন বৃদ্ধ আছে, যুদ্ধাহত মানুষ আছে যাহারা নিষ্পেষিত ও ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে অমানবিকতার রক্তাক্ত কৃপাণে।
অবশ্য আমরা যদি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ হইতে চিন্তা করি, তাহা হইলে এই গোল্ডেন রেকর্ডটির অসাধারণ দিকটি কল্পনা করিতে পারি। আমরা ইহা মনে করিতেই পারি যে, মানবজাতি কী হইতে চাহে, ভিনগ্রহবাসীর জন্য তাহার বার্তা দিয়া রাখা হইয়াছে এই গোল্ডেন রেকর্ডের ভিতরে। মানুষ চাহে একটি আনন্দময়, প্রেমময়, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, যুদ্ধহীন একটি স্বপ্নময় পৃথিবী। সেই পৃথিবীর চিত্রই তুলিয়া ধরা হইয়াছে গোল্ডেন রেকর্ডটিতে। ইহা হয়তো মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। নচেৎ, আমরা কী করিয়া বলিব-মানুষ আসলে বুদ্ধিমান প্রাণী?