ধরা যাউক, আমাদেরই কাহারো বয়স্ক এক দাদা পাড়ার চায়ের দোকানে বসিয়া যুগপৎ গর্ব ও আক্ষেপ করিয়া বলিলেন- 'আমি যখন ক্লাস ফাইভে প্রথম হইছিলাম আমারে লইয়া কত নাচানাচি, ফুর্তি হইল-সকল ফকফকা মনে আছে; কিন্তু কই, গত পরশু আমি দুপুরে কী দিয়া ভাত খাইছি, তাহা তো আর মনে নাই!'
দাদাদের মতো বয়স্ক মানুষের এমন অসংখ্য স্মৃতিভ্রষ্টতার কথা শুনিয়া আমরা বুঝিতে পারি-মানুষ যতই স্মৃতি আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকুক, তাহাদের অনেকেই একসময় অস্পষ্ট হইয়া পড়ে। ছোটবেলার পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মনে থাকে, অথচ গতকাল কোথায় চাবি রাখা হইয়াছে, তাহা মনে থাকে না। এই স্মৃতির খেলাই মানুষের জীবনকে রহস্যময়, কিছুটা হাস্যকর আর করুণ করিয়া তোলে। এই স্মৃতি-জটিলতার মাঝখানে যখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসিয়া আমাদের স্মৃতিকে যন্ত্রে সংরক্ষণের সম্ভাবনা তৈরি করে, তখন ইহা কেবল বিজ্ঞানের বিস্ময় নহে, বরং এক দার্শনিক ও নৈতিক প্রশ্নও হইয়া উঠে- 'আমরা কি সত্যিই আমাদের স্মৃতিকে যন্ত্রের হাতে তুলিয়া দিতে প্রস্তুত?'
সম্প্রতি কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন, যাহা স্মৃতি সংরক্ষণের কাজে মানুষের নিজস্ব মস্তিষ্ককেও পেছনে ফেলিতে পারে। 'পিসিএল-টেম্পো' নামক এই যন্ত্রটি মস্তিষ্কে বসাইলে স্মৃতি হারানোর ভয় আর থাকিবে না। অস্ত্রোপচার ছাড়াই মাথায় বসানো যাইবে, প্রয়োজন ফুরাইলে ইহা জলেই দ্রবীভূত হইয়া যাইবে-নাহ্, কোনো জঞ্জাল রাখিবে না। শুনিতে যেন ম্যাজিক; কিন্তু ইহাই বিজ্ঞান। এই যন্ত্র নাকি প্রতিদিনের ঘটনাও স্মৃতি হিসাবে ধরিয়া রাখিতে পারিবে। মানে আপনি সকালে দাঁত মাজিলেন, দুপুরে কতটা ভাত খাইলেন, আপনার প্রতিপক্ষকে কিংবা ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে কয়বার গালি দিলেন মনে মনে-সকলই স্মৃতিতে রেকর্ড হইবে!
তবে ইহার মধ্যে প্রযুক্তির চমক শুধু নহে, কিছু ভিন্ন প্রশ্নও জড়াইয়া রহিয়াছে। বিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, ইচ্ছানুযায়ী কোনো স্মৃতি মুছিয়া ফেলা যাইবে। যদি কেহ চাহে, তাহা হইলে প্রেমে প্রত্যাখ্যান বা অফিসে অপমানের স্মৃতি একেবারে- 'ডিলিট'! মানুষ আসলে সুখস্মৃতি লালন করিতে চাহে, দুঃখস্মৃতি ভুলিতে চাহে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষ দুঃখ হইতে শেখে, সুখ হইতে প্রেরণা গ্রহণ করে। এই জন্যই স্মৃতি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই জন্যই ইহার রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দায়িত্বপূর্ণ কর্ম। ইহা ছাড়াও স্মৃতি মুছিবার ক্ষমতা মানবিক মূল্যবোধের দিক হইতেও বিপজ্জনক বটে। অপরাধী যদি স্মৃতি মুছিয়া ফেলে, তাহা হইলে মনে করিবে-সে নিরপরাধ। তাহার মধ্যে কোনো অনুশোচনা তৈরি হইবে না। আর যদি কেহ কাহারো স্মৃতি চুরি করিয়া অন্যকে বিভ্রান্ত বা ব্ল্যাকমেইল করে, তখন কী হইবে? স্মৃতি তো শুধু 'তথ্য' নহে, ইহা অনুভব, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে গঠিত এক জটিল রসায়ন। আমরা যাহা পড়ি, দেখি, শুনি, তাহার সকল কিছুই নহে বরং হৃদয়স্পর্শী অংশটুকুই স্মৃতির মর্মে স্থান পায়। অতএব যন্ত্র যদি কেবল তথ্য জমা করে, তাহা হইলে সেই অনুভব কোথায়?
বিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, যখন মানুষ সকল কিছু যন্ত্রের উপর নির্ভর করে, তাহার নিজের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস পাইতে থাকে। স্মৃতিশক্তি একটি পেশির মতো-চর্চা না করিলে দুর্বল হইয়া পড়ে। যদি মানুষ স্মরণ করিবার প্রয়োজনই অনুভব না করে, তাহা হইলে একদিন হয়তো স্মৃতিশক্তিই বিলুপ্তই হইয়া যাইবে। স্মৃতি এমন এক সেতু, যাহা অতীত ও বর্তমানকে যুক্ত করে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়। প্রযুক্তি যদি ভবিষ্যতে মানুষের স্মৃতিকে ধারণ করিতেই পারে, তাহা হইলে মানুষকেই ইহার সুবিধা-অসুবিধা অনুধাবন করিতে হইবে। না হইলে একদিন হয়তো দেখা যাইবে, দাদা সেই একই চায়ের দোকানে বসিয়া বলিতেছেন-'এই যে আমি না ক্লাস ফাইভে প্রথম হইছিলাম... বাকিটা মনে নাই, কারণ ডিভাইসটা তো আপডেট করা হয় নাই!'