যুদ্ধ-মেশিনের গর্জনে প্রকম্পিত, জর্জরিত হইয়া উঠিয়াছে আমাদের এই সুনির্মল ধূলিধরা। ভ্রষ্ট আদর্শের বিভ্রান্তির জালে জড়াইয়া জাতিগুলি যেই সংঘাত-হানাহানিতে মাতিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে কেবল চারিদিকে যুদ্ধোত্তর অনিশ্চয়তা এবং উদ্বাস্তু দশাই বিরাজমান। ইউক্রেন, গাজা, ইয়েমেন, সুদান কিংবা মিয়ানমারে যুদ্ধের বিভীষিকা গ্রাস করিতেছে মানবসভ্যতাকে। প্রখ্যাত লেখক জর্জ ওরওয়েল আমাদের ব্যাখ্যা করিয়া দেখাইয়াছেন, যুদ্ধবাজ জাতি বা সরকারগুলি কীভাবে 'মানুষের মনে' যুদ্ধ-সংঘাতের বীজ বপন করিয়া থাকে; তাহার লেখা একটি বিখ্যাত লাইন- 'যুদ্ধই শান্তি। স্বাধীনতা হইল দাসত্ব। অজ্ঞতাই শক্তি।'
ইহা কেমন কথা! যুদ্ধ কী করিয়া শান্তি হইতে পারে? স্বাধীনতাকে কি কোনোভাবে দাসত্বের সংজ্ঞায় ফেলানো যায়? আবার অজ্ঞতা কীভাবে শক্তি হইতে পারে, যেইখানে 'জ্ঞানই শক্তি' বিশ্বময় প্রচলিত ও গ্রহণীয় একটি পাঠ? এই আপাতবিরোধী বাক্য বা শব্দগুলি আসলে 'একটি রাজনীতিনির্ভর সমাজব্যবস্থার মানসিক অস্ত্র'-যাহা কেবল সংঘাত-সংঘর্ষের পথেই জাতিগুলিকে পরিচালিত করিতেছে। অর্থাৎ, যুদ্ধ-সংঘাত, হানাহানির ঘুণপোকা অত্যন্ত সন্তর্পণে মানুষের মগজে ঢুকাইয়া দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না যুদ্ধবাজ শক্তিগুলি। এমনকি তাহারা ইহাও সদম্ভে প্রচার করিয়া থাকে যে, 'এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন ওয়ার।' যুদ্ধবিগ্রহের এহেন মর্মন্তুদ বাস্তবতা উপলব্ধি করিয়া যুদ্ধবিরোধী লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করিয়া বলেন, 'এই সকল কিছুর কি কোনো মানে আছে?' কোনো এক সুন্দর প্রভাতে রেমার্ক আমাদের এ-ও স্মরণ করাইয়া দিয়া যান যে, 'যুদ্ধ মানুষকে শুধু মারে না, বরং মানবিকতাকে বিলীন করে।'
যুদ্ধের ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন বটে। এই অর্থে, বর্তমান বা তথাকথিক আধুনিক সমাজ হানাহানিমুক্ত থাকিতে পারে না; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত যুদ্ধগুলি যেন মানবতাকে একেবারে মুমূর্ষু করিয়া তুলিয়াছে। বিশেষ করিয়া বলিতে হয় গাজা যুদ্ধের কথা। এই সংঘাতে এখনো প্রতিদিন হাজারো নারী-শিশু বেঘোরে মারা পড়িতেছে, যাহা যুদ্ধের সরাসরি লংঘন। সমগ্র বিশ্ব প্রত্যক্ষ করিতেছে ভুক্তভোগী গাজাবাসীর মানবেতর জীবনযাপন। সেইখানে খাদ্যসংকট তীব্রতর হইয়া উঠিয়াছে। গাজায় খাদ্য সহায়তা এখন 'মৃত্যুফাঁদ' হইয়া উঠিয়াছে! ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ গাজাবাসীকে লক্ষ্য করিয়া বুলেট-বোমা ছুড়িয়া শেষ করা হইতেছে ক্ষুধাতুর প্রাণগুলিকে। অমানবিকতা এইখানে শেষ নহে! আরেক ভয়াবহ অভিযোগ উঠিয়াছে যে, গাজায় ত্রাণের ময়দার মধ্যে মিশাইয়া দেওয়া হইতেছে মাদক বড়ি! বাঁচিয়া থাকার জন্য যেইখানে গাজার মানুষকে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়া আটা সংগ্রহ করিতে হইতেছে, সেই মহামূল্যবান আটার বস্তার মধ্যে ঢুকাইয়া দেওয়া হইতেছে মাদকদ্রব্য! এমন অসভ্যতা, বর্বতার চূড়ান্ত নমুনা আর কী হইতে পারে!
যুদ্ধের নানা আইন, নিয়মনীতি রহিয়াছে; মানবতাকে সুরক্ষার স্বার্থে জেনেভা কনভেনশনের ন্যায় বহু রক্ষাকবচ আছে; কিন্তু তাহা যেন কেবল কাগজে কলমেই। অথচ অতীতে এমনও পরিবেশ ছিল, যখন যুদ্ধের ময়দানে একধরনের 'ল' বা ডিসিপ্লিন প্রত্যক্ষ করা যাইত; উদাহরণস্বরূপ, কেবল সেনাপতি-সেনাপতি লড়াই বাধিত, বাকি সৈন্যসামন্ত শুধু দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিত; সেই লড়াইয়ে সেনাপতির একার রণকৌশলেই নির্ধারিত হইত চূড়ান্ত বিজয়। আবার এমনও ছিল, কেহ কাহাকে পিছন দিক হইতে আঘাত করিত না; কিন্তু আজিকার সমাজে আমরা কী প্রত্যক্ষ করিতেছি? আধুনিক সংঘাত মানেই যেন কেবল ষড়যন্ত্র, নীলনকশা কিংবা পিছন দিক হইতে কাপুরুষোচিত নগ্ন হামলা। আর এইভাবে প্রতিদিন শত শত তাজা প্রাণ ঝরিতেছে, মানবতা ভূলুণ্ঠিত হইতেছে পদে পদে।
যুদ্ধবিরোধী কিশোরী লেখক অ্যান ফ্রাংক যুদ্ধের চরম ভয়াবহতার মধ্যে দাঁড়াইয়া অত্যন্ত সাবলীলভাবে লিখিয়া গিয়াছেন, 'আমি সমস্ত দুর্দশার কথা ভাবি না, বরং সেই সৌন্দর্যের কথা ভাবি, যাহা এখনো অবশিষ্ট আছে।' আমরা কি ফ্রাংকের এই মানবতার আহ্বানের মর্মার্থ উপলব্ধি করিতে পারি? আমরা কি তাহার ডাকে সাড়া দিয়া মানুষের প্রতি মানবিক, সদয় আচরণে উদ্বুদ্ধ হইতে পারি না? আমরা কি যুদ্ধকবলিত প্রাণগুলিকে 'মুক্ত' করিয়া মানবতাকে বিজয়ী করিতে পারি না?