আমরা কিছু কিছু পুরোনো তথ্যচিত্রে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা মনেই করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আর যেন কিছু নেই। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আরো যে অনেক দেশ রয়েছে, সেটা সেখানকার বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ গোনার মধ্যেই ধরেন না।
আজ যুক্তরাষ্ট্রের মহান স্বাধীনতা দিবস। মাত্র ২৫০ বছর আগে কিছু পরাধীন রাজ্য একত্র হয়ে কী করে ক্রমশ বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির দেশ হয়ে উঠল? বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৩৪ কোটির বেশি। এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ জাতিগোষ্ঠী প্রায় ৫৭.৮ শতাংশ। অন্যদিকে হিস্পানিক বা লাতিনো রয়েছে ২০, কৃষ্ণাঙ্গ জনসংখ্যা ১২.১ এবং এশীয় ৫.৯ শতাংশ। আর নেটিভআমেরিকান (আলাস্কা ও প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ মিলিয়ে) মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
অর্থাৎ দেশটির আদি অধিবাসী অত্যন্ত নগণ্য। এজন্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা দেন-'যুক্তরাষ্ট্র থেকে সব অবৈধ অভিবাসীকে বের করে দেওয়া হবে'-তখন একটি বিখ্যাত কার্টুন ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি বসে আছেন এক আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান। তিনি ট্রাম্পকে বলছেন, তুমি কবে দেশ ছাড়বে? অর্থাৎ যদি শেকড়ের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেশটির সবাই তো কোনো না কোনো প্রজন্মের হাত ধরে এসে অভিবাসী হয়েছে। যেমন, বর্তমান প্রেসিডেন্টের পিতামহ ফ্রিডরিখ ট্রাম্প জার্মানি থেকে ১৮৮৫ সালে ১৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।
আসলে ইউরোপের নানা দেশ থেকে অসংখ্য ভাগ্যান্বেষী এবং স্বাধীনচেতা মেধাবী মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আগমনের ইতিহাস পাঠ অতি জরুরি। প্রথম অভিবাসনের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল ইংরেজদের মাধ্যমে। মূলত ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের সময় একদল ইংরেজ হল্যান্ডে এসে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্য থেকে একদল ইংরেজ 'মে ফ্লাওয়ার' নামক একটি জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসে নতুন বসতি স্থাপন করেন।
নতুন এই উপনিবেশকারীরা আমেরিকার ইতিহাসে 'পিলগ্রিম ফাদার্স' নামে পরিচিত। এরা সংখ্যায় কিন্তু মাত্র ৯২ জন ছিলেন। এরাই ১৬২০ সালের নভেম্বর মাসে একটি স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক চুক্তি অনুযায়ী নতুন প্লিমথ নামক একটি গণতান্ত্রিক জনপদের গোড়াপত্তন করেন। এভাবেই উত্তর আমেরিকায় প্রথম আধুনিক জনপদের সূত্রপাত হয়। ইংল্যান্ড ছাড়াও ১৬৮০ পর্যন্ত হল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ থেকে অল্প অল্প করে অভিবাসীরা আমেরিকায় পা রাখেন। ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আগত অভিবাসীদের ধারা অষ্টাদশ শতাব্দীতে অব্যাহত থাকে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লাখ।
তবে উপনিবেশকারীদের মধ্যে ইংরেজদের সংখ্যা বেশি থাকায় তারা ইংল্যান্ডেরই স্বাধীনতামূলক আইনগুলো প্রবর্তন করেন। এজন্য আমরা দেখতে পাই ম্যাগনা কার্টা হ্যাকিয়াস কর্পাস আইন, বিল অব রাইটস, ইংল্যান্ডের কমন ল প্রভৃতি আইন নতুন অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের নিজ নিজ উপনিবেশে প্রবর্তন করেন। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একদম শুরু থেকেই সব ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে এই জনপদগুলো গঠিত হচ্ছিল।
তবে সে সময় কোনো উপনিবেশ তৈরি করতে হলে ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে সনদ নিতে হতো। ইংরেজ রাজার প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর নিযুক্ত থাকতেন। এই ঘটনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই আমেরিকার স্বাধীনতা এবং ঐক্যের সূত্রপাত ঘটে। ঘটনার ঘনঘটায় ১৭৬৩ সালে ইংরেজ-ফরাসি যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটে এবং ফরাসিরা উত্তর আমেরিকা থেকেও বিতাড়িত হয়।
কিন্তু ফরাসিদের সঙ্গে সাত বছরের যুদ্ধে ইংরেজ সরকারের বহু দেনা হয়ে যায় এবং এই দেনা শোধের জন্য বেশি বেশি রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলো থেকে। আর এখান থেকেই শুরু হয় ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমেরিকার উপনিবেশগুলির সংঘাত। তারা কেন মানবে ইংল্যান্ডের অন্যায্য অতিরিক্ত রাজস্বের আবদার? আমেরিকায় শুরু হয় বিক্ষোভও অসন্তোষ। এই বিক্ষোভকে সমুচিত জবাব দিতে সে সময় ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ ও প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ কঠোর সিদ্ধান্ত নেন।
খুবই নাটকীয় সময় এটি। আমরা দেখতে পাই, ইংল্যান্ডের উচিত শিক্ষা মোকাবিলা করতেই ১৭৭৪ সালে আমেরিকার সব উপনিবেশের প্রতিনিধিরা একটি 'কনটিনেন্টাল কংগ্রেস' প্রতিষ্ঠা করেন, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের থেকে স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে আমেরিকার সব উপনিবেশের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। এই ঐক্যই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রধান ভিত্তি অর্থায় সবাই মিলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। আর এভাবেই ১৩টি রাষ্ট্র নিয়ে প্রথম কনফেডারেশন বা রাষ্ট্রসমষ্টির ভিত্তিপত্তন করা হয়।
এই হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পথচলা। আর এই পথচলায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ছিল অমূল্য সম্পদ। ১৭৭৬ সালে সেই ঐক্যই পরিণত হয় একটি রাষ্ট্রীয় ঘোষণায়, যেখানে বলা হয়: All men are created equal...with unalienable rights...Life, Liberty and the pursuit of Happiness, (সব মানুষ সমভাবে সৃষ্টি হয়েছে... এবং তারা কিছু এমন অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, যা কখনো কেড়ে নেওয়া যায় না... যেমন-জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সুখের সন্ধানের অধিকার। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৭৭৬)।
এই ঘোষণা কেবল রাজনৈতিক নয়, তা ছিল দার্শনিক ও নৈতিক বুনিয়াদের দলিল। এনলাইটমেন্টের যুগের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ গড়পড়তা মানুষের ভেতর আত্মবিশ্বাস জন্ম দিল যে, রাষ্ট্র জনগণের জন্য, রাজার জন্য নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এতটাই শক্তিশালী যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অন্তর্ভুক্ত রাজ্যেরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার সুযোগ নেই; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র একটি পারপিচুয়াল ইউনিয়ন বা চিরস্থায়ী সংযুক্তিকৃত রাষ্ট্র। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়েই রক্তের অক্ষরে এই জাতির স্থায়ী ইতিহাস লিখিত হয়ে গেছে।
সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র যেন আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমাদের ব্রহ্মাও বৈচিত্রময়। যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই। বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাই এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে; অর্থাৎ রাষ্ট্র এক, কিন্তু জাতির মধ্যে রয়েছে বহুত্ব। আর এটাই হলো মেল্টিং পট। মেন্টিং পটের মধ্যে যেমন সব ধাতু গলে একটি নতুন বৈশিষ্ট্যে ধাতুতে রূপান্তরিত হয়, যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের মূলভিত্তি, আত্মশক্তি।
যুক্তরাষ্ট্র যেন সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে এই বার্তা দেয়-'তুমি কে, সেটা তোমার বংশ না, তোমার কাজ বলে দেবে-তুমি কে।' এমনকি কেউ যদি আফ্রিকার কোনো দরিদ্র গ্রাম থেকে এসেও সেখানে পৌঁছাতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে 'দ্য আমেরিকান ড্রিম' নামে একটি জায়গা দেয়-যেখানে নিজের জীবন নিজেই লিখতে পারেন। সেভাবেই জীবন লিখেছেন শত শত বিখ্যাত মানুষ। যেমন বারাক ওবামা। স্বপ্ন কত বড় এবং সার্থকময় হতে পারে, সেটা দেখিয়েছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। সুতরাং যারা যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল এক শ্বেতাঙ্গ দেশের প্রতিভূ ভাবেন, তারা ভুলে যান এই রাষ্ট্র গঠনের মূল উপাদান-অভিবাসন।
সিলিকন ভ্যালির নেপথ্যে যেমন ভারতীয় বা চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকের অবদান রয়েছে, তেমনি নাসার গবেষণাগারে রয়েছেন নাইজেরিয়ান, ইরানি, কোরিয়ান বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়, তারা হয়ে উঠেছে চিন্তার কারখানা। হার্ভার্ড, এমআইটি, ইয়েল, প্রিন্সটন-এগুলি একদিকে যেমন রাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব রাখে, তেমনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসার দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটায়। এভাবে বিজ্ঞানচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এই মেলবন্ধনই যুক্তরাষ্ট্রকে করে তুলেছে অন্যদের থেকে আলাদা। সুতরাং আমরা বুঝতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি কোথায়। তারা পরমাণু বোমার চাইতেও শক্তিশালী এসব প্রতিষ্ঠান।
পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান বস্তুর মধ্যেও খুঁত থাকে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও নিখুঁত নয়। তার ইতিহাসে দাসপ্রথা, গণহত্যা, শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবাদ-সবই আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভুল স্বীকার করে এবং নিজেকে শোধরায়। এ কারণে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, বরং একটি অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এটি হলো জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের, নাগরিকের সঙ্গে মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত। এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল আজকের দিন-১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই। বলা হয়েছিল-সব মানুষ সমান এবং প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার-স্বাধীনতা ও সুখসন্ধান। এই দর্শনই যুক্তরাষ্ট্রকে পরাশক্তি করেছে এবং এটাই তার সত্যিকার আত্মশক্তি। সাময়িক যত বিভ্রান্তিই বা বিচ্যুতিই আসুক না কেন-এই দর্শন ও সত্যই যুক্তরাষ্ট্রের শেষ কথা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার