দিগন্ত জুড়িয়া উত্তপ্ত বাতাস বহিয়া চলিতেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করিয়া ইউরোপের দক্ষিণাংশ যেন এক অগ্নিকুণ্ড। স্পেনের হুয়েলভা অঞ্চলে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হইয়াছে-ইহা জুন মাসে সেই দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল এবং পশ্চিম বালকান অঞ্চলেও চরম উষ্ণতা বিদ্যমান। দাবদাহের ফলে দাবানল ছড়াইতেছে, হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ছাড়িয়া যাইতেছে।
চলমান দাবদাহ, রেকর্ড-ভাঙা তাপমাত্রা, ছড়াইয়া পড়া দাবানল এবং হাজারো মৃত্যুর আশঙ্কা-সকল মিলাইয়া এক নির্মম বাস্তবতা আমাদের সামনে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। বলা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জ্বলন্ত বার্তা দিতেছে ইউরোপের দাবদাহ। যেন প্রকৃতি নিজেই এক চরম হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়া বলিতেছে-আমরা যেন জাগিয়া জাগিয়া ঘুমাইয়া না থাকি!
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হইতেছে-এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি কেবল আবহাওয়ার স্বাভাবিক চক্রের অংশ? নাকি ইহা মনুষ্যসৃষ্ট উষ্ণায়নের ফল? বিজ্ঞান বলিতেছে, স্পষ্টত দ্বিতীয়টিই সত্য। সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণে দেখা গিয়াছে, ইউরোপে গত কয়েক দশকে সংঘটিত ১১৬টি তাপপ্রবাহের মধ্যে ১১০টি (অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিকতর তীব্র ও সম্ভাব্য হইয়াছে। প্রাক্-শিল্প যুগের তুলনায় আজকে এইরূপ দাবদাহ ১০ গুণ বেশি সম্ভাব্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলিতেছে, বিগত শতকের তুলনায় ইউরোপ এখন প্রতি দশকে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি হারে উষ্ণ হইতেছে-যেইখানে বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি। ইউরোপ তাই পৃথিবীর সবচাইতে দ্রুত উষ্ণ হইতে থাকা মহাদেশ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৫০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ইউরোপে যে ৩০টি সবচেয়ে ভয়াবহ দাবদাহ দেখা গিয়াছে, তাহার মধ্যে ২৩টিই ঘটিয়াছে ২০০০ সালের পর। ইহা নিছক কাকতালীয় নহে; বরং জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিমিত ব্যবহার, বনাঞ্চলের ক্ষয় এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের এক যৌক্তিক পরিণতি। যাহারা বলিয়া থাকেন, পরিবেশ রক্ষার কাজ 'বিলাসিতা', তাহাদের উপলব্ধি করা উচিত-আজকের দাবদাহ আমাদের জানান দিতেছে, বিলাসিতা নহে বরং বাঁচিয়া থাকিবার অপরিহার্য শর্ত হইতেছে পরিবেশ রক্ষা।
আজকের ইউরোপ একটি 'হিট ডোম'-এর কবলে। ইহা একটি উচ্চচাপ বলয়ের মাধ্যমে তৈরি আবহাওয়া ব্যবস্থা, যাহা গরম বাতাসকে জমাট করিয়া রাখে এবং দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ ঘটায়। ফলে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়িতে থাকে এবং তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী ও বিস্তৃত হয়। উক্ত পরিস্থিতিতে দাবানলের ঝুঁকিও বহুগুণে বৃদ্ধি পাইতেছে, যেমন ঘটিতেছে তুরস্ক, আলবেনিয়া ও গ্রিসে। গবেষণা বলিতেছে, এমন প্রবণতা আগামী দিনে আরো তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হইবে। শুধু তাপপ্রবাহই নহে, ইহার সঙ্গে যুক্ত হইতেছে দাবানল, সমুদ্রের উপর তাপপ্রবাহ, খরা ও বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলিয়াছেন-'এখন আর প্রশ্ন থাকিতেছে না, কবে তাপপ্রবাহ ঘটিবে। বরং প্রশ্ন হইতেছে, কতবার ঘটিবে এবং কতদিন স্থায়ী হইবে।' পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হইতেছে, কারণ ইউরোপের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনো প্রস্তুত নহে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপ অঞ্চলের ৫৭টি দেশের মধ্যে কেবল ২১টি দেশে 'ন্যাশনাল হিট হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান' বিদ্যমান। তাহার মধ্যে মাত্র ১৪টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।
তবে এ বিপদের মধ্যে থেকেও একটি সুযোগ তৈরি হইয়াছে-আমরা যদি এখনই জাগিয়া না উঠি, তাহা হইলে ভবিষ্যতের বিপর্যয় আরো ভয়াবহ হইবে। এই পৃথিবীই আমাদের একমাত্র প্লানেট তথা আবাসভূমি। 'প্লানেট বি' বলিয়া কিছু নাই, সুতরাং এই সমস্যা সমাধানে কোনো দ্বিতীয় প্লান তথা 'প্লান বি' নাই। সুতরাং ইউরোপের এই দাবদাহ যেন এক জ্বলন্ত বার্তা-অপেক্ষার প্রহর ফুরাইয়া আসিতেছে। এখনই সময়সচেতন হইবার, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। আজকের প্রকৃতি যেন দাবদাহের অগ্নি অক্ষরে লিখিয়া দিতেছে-আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ শুধু তপ্তই নহে, ধ্বংসাত্মক হইবে।