স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে প্রত্যাশিত এই পরিবর্তন বদলে দেবে অনেক কিছুই। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে বিশ্বব্যাপী চলমান অনিশ্চয়তার প্রভাবকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। সম্ভাব্য বৈশ্বিক সংঘাত, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাতের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বদলে ফেলছে তাদের জনসম্পদ ব্যবস্থাপনা।
নাগরিকদের দক্ষতার বিকাশ আজ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই আটকে নেই, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এসবের মধ্যেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটে দক্ষ, প্রতিযোগিতাপূর্ণ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু এর পরও প্রশ্ন থেকে যায়, বর্তমান অনিশ্চিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বে এই বাজেট আসলে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?
ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার শিক্ষা
শিক্ষাকে এখন শুধু মানুষের সাক্ষরতা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না, এটি এখন হয়ে উঠেছে একটি রাষ্ট্রের কৌশলগত মূলধন, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার প্রধান হাতিয়ার। যে দেশগুলো তাদের মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে, তারাই আজ বিশ্ববাণিজ্য, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। বাংলাদেশের প্রায় ২৮ শতাংশ নাগরিকের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। এই বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর অন্যতম জোগানদাতা হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। তবে এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি।
বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার সাঙ্গে তাল মেলাতে বাংলাদেশের মান্ধাতা আমলের শিক্ষাব্যবস্থার বদলে আধুনিক, দূরদর্শী ও দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় মানানসই একটি শিক্ষাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে আমাদের জাতীয় লক্ষ্যকে বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। বিদেশে কাজের জন্য নিম্ন আয়ের অদক্ষ কর্মী পাঠানোর বদলে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, ডিজিটাল সার্ভিস কর্মী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও একাধিক ভাষায় দক্ষ পেশাদার কর্মী তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বৈশ্বিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস থেকেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। পরিবর্তন চলে আসার পর খাপ খাওয়ানোর সময় এখন নেই বললেই চলে।
ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের মতো দেশের উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, বিশ্বের চাহিদাকে মাথায় রেখে শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে এর সুফল আরো বহু গুণে ফিরে আসবে। এই দুইটি দেশের ক্ষেত্রেই শিক্ষা বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণে কৌশলগত অগ্রাধিকার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন ও শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, গত অর্থবছরের তুলনায় যা মাত্র ১ শতাংশ বেশি। মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষায় প্রায় ৭-৮ শতাংশ বরাদ্দ বাড়লেও প্রাথমিক শিক্ষায় কমেছে ৯ শতাংশ আর সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় বরাদ্দ দেশের মোট জিডিপির মাত্র ১.৫ শতাংশ। অথচ ইউনেসকোর মতে, একটি দেশের জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত।
এই সামান্য বরাদ্দের অর্থ হলো, আমাদের বাজেট বাস্তবায়নে হতে হবে আরো কৌশলী, দিতে হবে খাতভিত্তিক প্রাধান্য। প্রতিযোগিতাপূর্ণ দুনিয়ায় টিকে থাকতে নজর দিতে হবে ভাষাগত দক্ষতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা, STEM এডুকেশন ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থায়। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তনের সুযোগকে সীমিত করে ফেলেছে এই স্বল্প বাজেট বরাদ্দ।
সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই বাজেটে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, পেশাগত উন্নয়ন কিংবা প্রণোদনা সংক্রান্ত কোনো কার্যকর পরিকল্পনারই অস্তিত্ব নেই। অথচ শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকই হচ্ছেন কেন্দ্রবিন্দু। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে আমাদের দুর্বলতা দীর্ঘদিনের। একে ভাঙতে হলে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে কাঠামোগত বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিক্ষক ও তার দেওয়া পাঠ মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার মানও বাড়ানো সম্ভব তখন।
শ্রমবাজারের যুদ্ধ
বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অতি জাতীয়তাবাদী নীতি ও অটোমেশনের প্রভাবে শ্রম অভিবাসনের প্রচলিত পথ সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবেই অদক্ষ শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সুযোগ আর খুব বেশিদিন থাকবে না।
ভিয়েতনাম (শিক্ষা বাজেট জিডিপির ২.৯ শতাংশ), ফিলিপাইন (৩.৬ শতাংশ) ও ভারত (৪.১ শতাংশ) ইতিমধ্যে কর্মমুখী শিক্ষা, ডিজিটাল দক্ষতা ও খাতভিত্তিক জনশক্তি তৈরিতে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈশ্বিক শ্রম বাজারের বড় অংশ দখল করেছে। স্বল্প বেতনের অদক্ষ শ্রমিকের কাজ নয়, দেশগুলোর প্রশিক্ষিত জনবল কাজ করছে উচ্চ বেতনের দক্ষতানির্ভর খাতগুলোতে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশে বিদ্যমান টেকনিক্যাল ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (TVET) অবকাঠামোকে দ্রুত আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এসব কেন্দ্র তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। বিদেশের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষাবিদদের এসব প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন বা পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের সহযোগিতায় পাঠ্যক্রমগুলোকে আরো যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত করা যেতে পারে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক শ্রম চুক্তি, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, কর প্রণোদনা, আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজীকরণসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে আমাদের দক্ষ শ্রমশক্তি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতা শুধু সস্তা শ্রমের জন্য হবে না, হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, যে কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারা কর্মীর জন্য। আর তাই বাংলাদেশকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সুপারিশ
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীদের কাছ থেকে যে সুপারিশগুলো বারবার এসেছে, তার মধ্যে কয়েকটি হলো-
১. আগামী তিন বছরের মধ্যে শিক্ষা বাজেট জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশে উন্নীত করা।
২. শিক্ষার সব স্তরে ইংরেজি, গণিত, আর্থিক সাক্ষরতা ও ডিজিটাল দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
৩. আন্তর্জাতিক শিক্ষামূল্যায়ন পরীক্ষাগুলোতে (যেমন PISA) অংশগ্রহণের জন্য একটি রোড ম্যাপ প্রণয়ন।
৪. কর্মমুখী ও উচ্চশিক্ষাকে রপ্তানিযোগ্য ও কৌশলগত খাতগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা। যেমন: নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, লজিস্টিকস, জলবায়ু অভিযোজন।
৫. পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, সনদ ও চাকরির জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা।
৬. নৈতিক নেতৃত্ব ও বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তির মতো বিষয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, যা তরুণদের বর্তমানে বিভাজিত ও তথ্যযুদ্ধে লিপ্ত বিশ্বে দেখাবে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ।
অনিশ্চিত বিশ্বে শিক্ষাই সম্বল
শিক্ষা সব সময়ই ছিল ক্ষমতায়নের মাধ্যম। তবে বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একধরনের প্রস্তুতিও, যা একটি জাতিকে বৈশ্বিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পৃথিবী নির্মাণেও অংশীদার করে তুলতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য এক নতুন যাত্রার কেবল শুরুর ধাপ। সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ আসবে এর পরই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমনভাবে প্রস্তুত করার চ্যালেঞ্জ, যাতে তারা একটি বিভাজিত, প্রযুক্তিনির্ভর ও সম্ভাব্য সংঘাতময় বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের শিক্ষা বাজেট সীমিত হলেও এটি আমাদের জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। দূরদর্শিতার সঙ্গে এই বাজেট বাস্তবায়িত হলে এখান থেকেই গড়ে উঠতে পারে দক্ষ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও বৈশ্বিক চাহিদাসম্পন্ন জনশক্তি। এই অনিশ্চয়তার সময়ে একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এবং বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
লেখক: পার্টনার, স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
প্রতিষ্ঠাতা, চলপড়ি