শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

পবিত্র আশুরার শিক্ষা

আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৫:০০

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহরমের দশম দিবসকে বলা হয় আশুরা। আরবি আশুরা অর্থ দশম। পবিত্র এই দিবসটি মুসলিম উম্মাহর নিকট এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও শোকাবহ দিবস রূ পে পরিগণিত। ইহার প্রধান কারণ এই যে, এই দিন কারবালার প্রান্তরে মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) স্বীয় পরিবারবর্গ ও কতিপয় সঙ্গী সহকারে শাহাদত বরণ করিয়াছিলেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় তাহারা যেই আত্মত্যাগ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা মুসলিম জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইহা ছাড়াও, আশুরার দিন বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয় বলিয়া বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়; যেমন- এই দিন আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছিলেন, হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করিয়াছিলেন, হজরত নুহ (আ.) ও তাহার সহযাত্রীদের পৃথিবীর ভয়াবহ প্লাবন হইতে মুক্তি দান করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডু হইতে রক্ষা করেন। হজরত ইউনুস (আ.)-কে মাছের পেট হইতে উদ্ধার করেন। সর্বোপরি হজরত মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিয়া অলৌকিকভাবে লোহিতসাগর পার করাইয়া দেন। এই সকল কারণে আশুরা কেবল একটি শোকের দিবস নহে, ইহা ধৈর্য, সহনশীলতা ও আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার এক স্মারক।

বস্তুত পবিত্র হইল ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আপসহীন সংগ্রামের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি বাতিলের নিকট মাথা নত না করিয়া সত্য ও ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত রাখিবার জন্য যেই আত্মত্যাগ করেন, তাহা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এই ঘটনা মুসলিম সমাজে অন্যায়, অবিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাদায়ক। আশুরা দিবসের আরেক তাৎপর্য হইল, এই দিন বহু নবির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মোজেজা সংঘটিত হয়। এই সকল ঘটনা আল্লাহর অসীম কুদরত ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং তাহার নবিদের প্রতি তাহার অনুগ্রহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই কারণে আশুরার রোজার ফজিলত বা মর্যাদা অপরিসীম। হজরত মুহম্মদ (স.) আশুরার দিবসে রোজা রাখিতেন এবং তিনি এই রোজাকে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। এমনকি আশুরার রোজা রাখিলে পূর্ববর্তী এক বৎসরের গুনাহ মাফ হইয়া যায় বলিয়া হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে। তাই এই দিবসটি কেবল শোক ও স্মরণের দিবস নহে, একই সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগও বটে।

পবিত্র আশুরা আমাদের অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের শিক্ষা দেয়। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদত আমাদের এই কথা স্মরণ করাইয়া দেয় যে, সত্যের পথে অটল থাকিতে হইলে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে। দ্বিতীয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং তাহারই উপর সব কিছু সোপর্দ করিবার শিক্ষা আমরা আশুরা হইতে গ্রহণ করিতে পারি। তৃতীয়ত, ইহা আমাদের ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়। এই জন্য বলা হয়-'কাতলে হুসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ।' অর্থাৎ, হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা আসলে ইয়াজিদেরই মৃত্যু, ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়। মাওলানা মোহাম্মাদ আলী জওহারের এই উক্তি মুসলিম জীবনে আজও প্রযোজ্য।

পবিত্র আশুরার দিন আমাদের করণীয় হইল, প্রথমত রোজা রাখা। অন্তত মহরম মাসের নবম ও দশম অথবা দশম ও একাদশ দিবসে রোজা রাখা উচিত। দ্বিতীয়ত, নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। তৃতীয়ত, কারবালার ঘটনা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিজেদের জীবনে ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা ও ত্যাগের মহিমা ধারণ করা। পরিশেষে, পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে শোকের নামে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি বা অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া হইতে আমাদের বিরত থাকা একান্ত আবশ্যক। বরং, এই দিনটিকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করিবার এক সুবর্ণ সুযোগ রূপে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন