সকালের চায়ের সঙ্গে পত্রিকার পাতা উলটে যে প্রতিবেদনটি পড়লেন, সেটি লিখেছে কোনো রোবট সাংবাদিক, এই তথ্য জানার পর নিশ্চয়ই অবিশ্বাস্য লাগবে। সাংবাদিকতার নতুন যুগে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলছে অহরহ। এ ধরনের সাংবাদিকতাকে বলা হচ্ছে ‘অটোমেটেড জার্নালিজম’। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় ব্লুমবার্গ নিউজ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সংবাদ প্রকাশ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অটোমেটেড জার্নালিজমের মাধ্যমে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ২০১৬ রিও অলিম্পিকের সময় প্রায় ৩০০টি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভার্চুয়াল রোবট সাংবাদিকের মাধ্যমে। গণমাধ্যমে এই নতুন যুগের উত্থান সম্পর্কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নিউজ এজেন্সি ‘ন্যারেটিভ সাইন্স’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্রিশ্চিয়ান হ্যামন্ড জানিয়েছেন ‘আগামী ১৫ বছরের ভেতরে মোট সংবাদের ৯০ শতাংশ রচনা করবে রোবট সাংবাদিকেরা।
গণমাধ্যমের ভবিষ্যত্ কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের প্রভাব গণমাধ্যমেও পড়তে শুরু করেছে সমান হারে। গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার সঙ্গে গণমাধ্যমের সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বর্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকারের সংবাদপত্রের সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। ব্লগ ও ব্যাঙের ছাতাসদৃশ নিউজ পোর্টালকে হিসাবের মধ্যে ধরা হলে এই সংখ্যাটা কত হবে, সেটা অনুমান করা মুশকিল। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভেতর স্যাটেলাইট, লোকাল এবং ইন্টারনেট টিভি ইত্যাদির সংখ্যাও প্রায় ২৮ হাজার।
ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার লাভের ফলে গণমাধ্যম জগতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কাগুজে পত্রিকার অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রেসের ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে অনলাইন-ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল। অপরদিকে বিশাল অঙ্কের ব্যয়ভার বইতে না পেরে দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর বা নিউজ উইকের মতো অনেক শতবর্ষী গণমাধ্যমও প্রিন্ট এডিশনকে বিদায় জানতে বাধ্য হয়ে শুধু অনলাইন এডিশনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আবার কেউ কেউ হয়ে গেছে সংকুচিত। বাংলাদেশেও অনেক গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গিয়েছে একই কারণে। আর বর্তমান জমানার মানুষজনও কাগুজে সংবাদের চেয়ে অনলাইন সংস্করণকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
বর্তমানে সনাতন টিভি চ্যানেলের বিকল্প হয়ে উঠেছে ইউটিউব। প্রতি মিনিটে প্রায় ৩০০ ঘণ্টা সময়কালের ভিডিও আপলোড হয় ইউটিউবে। প্রতিদিন এসব ভিডিও দেখতে ইউটিউবে ঢু মারে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও কেব্ল মিডিয়ার পাশাপাশি ইউটিউবেও চালাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। ২০২৫ সালের ভেতরে টেলিভিশন মিডিয়ার একটি বৃহত্ অংশ ইউটিউব-ভিত্তিক হয়ে পড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্যের ৯ শতাংশ এখন ইউটিউব সংশ্লিষ্ট।
ফেসবুক এবং ইউটিউবের কল্যাণে এখন বিশ্বব্যাপী মোবাইল জার্নালিজম এবং সিটিজেন জার্নালিজমের জয়জয়কার। প্রতিষ্ঠিত সকল গণমাধ্যম এ কারণেই এখন ফেসবুক এবং ইউটিউবের দিকেই ঝুঁকছে। সনাতনী টিভি প্রোগ্রামকে চ্যলেঞ্জ জানাচ্ছে ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ। পৃথিবীর বড়ো বড়ো মিডিয়া হাউজগুলোর এখন মাথাব্যথা নেটফ্লিেক নিয়ে। বাংলাদেশেও এখন প্রথম আলো, যুগান্তর, ডেইলি স্টার, ইত্তেফাক, বিবিসি বাংলা, ডয়েসে ভেলের মতো গণমাধ্যম ইউটিউব ভিডিও, ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিংকে বেছে নিয়েছে নতুন যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এসব অনলাইন গণমাধ্যমেই বিজ্ঞাপন দিতে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, কারণ দর্শক প্রাপ্তি এখানেই বেশি। বিজ্ঞাপনের অভাবকে ঝুঁকির কারণ হিসেবে মনে করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া। গত দশকে ইন্টারনেটের প্রভাবে গণমাধ্যমের এই পরিবর্তন ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সেই পরিবর্তনও পুরোনো হয়ে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক অটোমেটেড জার্নালিজমের উত্থানের ফলে। ভার্চুয়াল রোবট সাংবাদিকদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে পরিবর্তনের সেই মিছিলে এরই মধ্যে যোগ দিয়েছে এপি, রয়টার্স, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, দ্য গার্ডিয়ানের মতো শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম। বর্তমানে শুধু খেলাধুলা, অর্থনীতি-বাণিজ্য, আবহাওয়া এবং ভূমিকম্পের সতর্কতাবিষয়ক সংবাদ প্রকাশ করা গেলেও আগামী দিনে নিউজ হেডলাইন বা সংবাদ শিরোনামও যে এই রোবট সাংবাদিকেরা করবে, সেটা সুস্পষ্ট।
চীনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ভার্চুয়াল উপস্থাপক এখন সংবাদ পাঠ করছে, আবহাওয়া বার্তা পড়ে শোনাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এ ধরনের ভার্চুয়াল উপস্থাপকেরা ইন্টারভিউ বা টকশো ধরনের অনুষ্ঠানও সঞ্চালন করতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে আগামীর পৃথিবীতে কর্মবাজারে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসবে। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের ভেতরে ৮০০ মিলিয়ন চাকরিতে মানুষের পরিবর্তে এ ধরনের রোবটকে নিয়োগ করা হবে। গণমাধ্যম শিল্পও বাদ যাবে না এই পরিবর্তন থেকে। সংবাদকর্মীরা সৃষ্টিশীল, স্বাধীনচেতা ও গতিময় হলেও অটোমেটেড জার্নালিস্টরা ক্রমশ গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করবে। ভার্চুয়াল এসব সংবাদ পাঠক বা রিপোর্টারদের পাওয়া যাবে মানুষ সাংবাদিক বা সংবাদ পাঠকের তুলনায় কম মূল্যে, এ কারণেই গণমাধ্যম মালিকেরা মানুষের চেয়ে অটোমেটেড জার্নালিস্টরা বেছে নেবে বেশি।
n লেখক :প্রকৌশলী এবং কলামিস্ট