শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মুজিববর্ষে অনন্য বইমেলা

আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৪:১০

বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার নান্দনিক সৌন্দর্য এ বছর অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় সেরা। বইয়ের স্টলগুলোর বিন্যাস ও সাজসজ্জা চমত্কার, বিশেষ করে প্যাভিলিয়নগুলোর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্বাধীনতা স্তম্ভকে ঘিরে যে প্রায় গোলাকার চত্বর, সেটা বইমেলার অংশ হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই প্রশস্ত মেলার বিশালতা যেন আরো বহুগুণ বিস্তার লাভ করেছে।

সন্ধ্যার পর জলের ওপর স্বাধীনতা স্তম্ভের আলোর প্রতিফলন বা ছায়া যেরকমটলোমল করে, তাতে চোখ নেচে ওঠে আর মন প্রফুল্ল হয়। আলোঝলমল মেলাটা এক কথায় অপরূপ। বইমেলার এরকম সন্ধ্যা যে না দেখেছে, সে নিজেকেই বঞ্চিত করেছে।

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে এ বছরের মেলাটি উত্সর্গ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বাংলা একাডেমি শেখ মুজিববিষয়ক ১০০ বই প্রকাশ করবে বছর জুড়ে। মাসব্যাপী প্রতিদিনের একাডেমি মঞ্চের বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ক্ষেত্রেও বাংলা একাডেমির পরিকল্পনাটা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই। প্রতিদিন একটি করে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই তারা প্রকাশ করছেন এবং মঞ্চে সেই বইয়ের একটি প্রকাশনা উত্সব ধরনের আলোচনা সভার আয়োজন করছেন।

বইয়ের স্টলগুলোয় এ বছর ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বইয়ের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। অতীতে যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছেন সচেতনভাবেই, তারাও এবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘বঙ্গবন্ধুবিষয়ক’ গ্রন্থ প্রকাশের হিড়িকে। এখানে মুজিবপ্রীতির চাইতে ‘বাণিজ্যটাই’ প্রধান উপজীব্য। কোনো কোনো প্রকাশক ৫০টি কিংবা তারও বেশি বই প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। লক্ষ্য মুনাফা।

মুজিববর্ষের ডামাডোলে যেন ভুলে না যাই পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই ঘনঘোর কৃষ্ণপক্ষকালকে।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ভয়াবহ একটা গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সারাদেশে। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এতটাই নৃশংস ছিল যে হতবিহবল বিমূঢ় মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক শোক প্রকাশও ছিল তখন রীতিমতো দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। পাথরচাপা সেই অন্ধকার সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতাপাঠের আসরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা পাঠ করার প্রথম দুঃসাহসটি দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।

পরের বছর, ১৯৭৮ সালের একুশের স্নিগ্ধ সকালে জাতির মননের প্রতীক সেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ঘটেছিল অবিস্মরণীয় আরেকটি ঘটনা। হঠাত্ করেই দু-তিন জন সাহসী মানুষ উদিত হয়েছিলেন বইমেলার মাঠে, কবিতাপাঠের আসরের শামিয়ানার আশপাশে। তাদের হাতে বঙ্গবন্ধুকে বিষয় করে রচিত একগুচ্ছ ছড়া আর কবিতার অনন্যসাধারণ সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। খুব দ্রুত, বলতে গেলে চোখের পলকে সেই সংকলনের সমস্ত কপি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এরকম একটি সংকলন হাতে পেয়ে মানুষের সে কী আবেগ! সে কী প্রতিক্রিয়া! অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে লুত্ফর রহমান রিটন পর্যন্ত মোট ৩০ জন লেখকের ছড়া-কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল সাহসী সেই সংকলনে।

ঐতিহাসিক এই সংকলনের প্রকাশক হিসেবে ‘সূর্যতরুণ গোষ্ঠী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর নাম মুদ্রিত হয়েছিল। এই নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন কোনো সংগঠন না থাকলেও প্রকাশক পরিচয়টি আংশিক সত্য ছিল। কারণ এই সংকলনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে। কক্ষটি বরাদ্দ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল আজীজের নামে। কেন্দ্রীয় খেলাঘরের মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ সংগঠক আবদুল আজীজ। এককভাবে সংকলনটির কোনো সম্পাদক না থাকলেও এই সংকলনের নেপথ্য কর্মী বা কলাকুশলীদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল আজীজ।

সেদিন অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ মুজিবকে নিয়ে সেই সংকলনে লেখা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।

একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই ছিল ১৯৭৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় প্রকাশিত ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ সংকলনটি। এখনকার প্রজন্ম হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, সংকলনটি প্রকাশকালে, বিয়াল্লিশ বছর আগে কী ভয়ংকর দমবন্ধ একটা অন্ধকার সময় বিরাজ করছিল বাংলাদেশে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণও একটা দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল তখন।

প্রতিকূল সময়ের যাত্রীদের কথা কি আমরা মনে রেখেছি?

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে পরের বছর একুশের বইমেলায় বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুবিষয়ক। সেই বইগুলোর লেখকেরা যে কিঞ্চিত্ সুবিধাবাদী, তাতে আর সন্দেহ কী?

আরো পড়ুন: গার্মেন্টস এক্সেসরিজ খাতে দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা

দুঃসময়ে, শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ভয়ংকর সময়ে, ইতিহাস বিকৃতির অন্ধকার সময়ে নিশ্চুপ থেকে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেই কেবল মুজিবপ্রেমী হিসেবে আবির্ভূত হলে সুযোগসন্ধানী লেখক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনাটি থেকেই যায়।

এবার মুজিববর্ষে শেখ মুজিব বিষয়ে বিপুলসংখ্যক গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের এই উত্সব বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকারী লেখকদের ‘গ্লানি মোচনের’ এক মহাসুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে বসবাস করে শেখ মুজিবকে অস্বীকার করা বাতাসের মধ্যে থেকে বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বাতাসকে অস্বীকার করার শামিল।

মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনার এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উত্সর্গ করা বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা তাই ভিন্ন এক তাত্পর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। একুশের বইমেলা বই কেনাবেচার মেলা নয় শুধু, একুশের বইমেলা বাঙালির চেতনাকে শানিত ও নবায়ন করার মেলা।

ইত্তেফাক/এএএম