আমাদের চোখের সামনেই বদলে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ‘কিশোর গ্যাং’-এর দৌরাত্ম্য আমাদের সবার নজরে এসেছে। বখাটেপনা, ছিনতাই, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা। এই তরুণরা ভিনগ্রহের বাসিন্দা নয়; আমার কিংবা আপনার সন্তান। আমাদের চোখের সামনেই তারা শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। কীভাবে কখন যে তারা বদলে যাচ্ছে, অপরাধে জড়াচ্ছে—তার খবর কি আমরা রাখছি? এই কিশোর-তরুণরা বিপথগামিতার জন্য কি শুধু নিজেরাই দায়ী? নাকি তার পরিবার, শিক্ষাঙ্গনেরও দায় রয়েছে। তাদের বিপথের পেছনে পিতা-মাতাও কি সমান দায়ী নয়?
সম্প্রতি বেশকিছু নৃশংস, চাঞ্চল্যকর ঘটনা মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে, শঙ্কিত করছে। যারা এই খুন আর নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তারা এমন হিংস্রতা কোথায় থেকে পেল। পারিবারিক মূল্যবোধ ও সুস্থ সম্পর্কের মধ্যে বেড়ে উঠলে তো এমন হওয়ার কথা না! নৈতিক অবক্ষয় ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতাই আমাদের তরুণ সমাজের ঐ শ্রেণির এমন হিংস্র বিধ্বংসী হয়ে উঠবার মূল কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিদরা।
সমাজবিদ অধ্যাপক নেহাল করিম বলছেন, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মতো যেসব ঘটনা ঘটছে তা যেন সম্প্রতি এসে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সমাজ এখন চালিত হচ্ছে মুনাফার দ্বারা। এখানে মুনাফাই সবকিছুর চালিকাশক্তি। একই সঙ্গে সমাজে ব্যক্তিকেন্দি কতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ব্যক্তিকেন্দি কতা ও মুনাফাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সেখানে মানুষের সামাজিক সংহতি কমতে থাকে। তখন অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ কমতে থাকে। এ সমাজব্যবস্থায় কেউ একজন সন্তুষ্ট হতে না পারলে অন্যের প্রতি সহিংস আচরণ করে। মানুষ যখন যে কোনো উপায়ে ধনী হতে চায়, তখন কোনো নীতি কাজ করে না। আবার অভাবের কারণে অনেকে পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ছে। এ অবস্থাও মানুষকে সহিংস করে তোলে কখনো কখনো। নেহাল করিম আরো বলেন, সব তরুণ কিন্তু খারাপ নয়। যারা দুর্বৃত্ত তাদের অধিকাংশের পেছনে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। তাদের ভেতর এমন একটা ধারণা তৈরি হয় যে, তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না।
সন্তানকে শৈশব, কৈশোর হয়ে তরুণ বয়স পর্যন্ত গড়ে তুলতে মা-বাবা এবং তার পরিবারের দায়িত্ব অনেক। তাকে খারাপ ভালোর বিচার করতে শেখানো পরিবারের দায়িত্ব। তাই সন্তানকে গড়ে তুলতে পরিবারের সবচাইতে বড় দায়িত্ব তার সামাজিকীকরণ এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ। যে শিশুটি ভবিষ্যতের নাগরিক, তার মনোজগত প্রস্তুত হয় পরিবারে। পরিবারের ধারা কেমন, কী ধরনের প্রথা-রীতিনীতি তারা মান্য করে, এসবের ওপর ভিত্তি করে একটি শিশুর জীবনভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাই শিশুর সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা তার মনে সাদা কাগজের পাতায় যে ছাপ রাখার মতো প্রভাব ফেলে। যা তার পরবর্তী জীবনে সুস্থ মানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে ভূমিকা রাখে।
এটা ঠিক, প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনছে। কিন্তু পারিবারিক অনুশাসন না থাকায় সেই প্রযুক্তি আর আকাশ সংস্কৃতির স্রোত আমাদের ভালোমন্দ চেনাতে পারছে না। পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে চলে আসায় একদল বন্ধুর সঙ্গে মিলে অভদ্র ও বেপরোয়া আচরণ করা, মানুষকে অসম্মান করাটাকে অনেকে স্মার্টনেস হিসেবে মনে করছে। এসব তথাকথিত ‘স্মার্টদের’ কাছে ভালো পরিবারের সহজ-সরল, সৎ, পড়ুয়া এবং বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তানরা ‘খ্যাৎ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তাদের সুন্দর আচরণের প্রশংসার পরিবর্তে বিদ্রুপ করে। ফলে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তারাও হতাশ হয়ে কখনো কখনো রুখে দাঁড়িয়ে ওদের চেয়েও খারাপ হয়ে যায়।
অথচ নৈতিকতা এবং ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা স্কুল-কলেজের বাইরে পরিবার থেকেই পায় সবাই। সেই পরিবার কাঠামোই তো এখন ভেঙে গেছে। অথচ এই পারিবারিক শৃঙ্খলার মধ্যে ছেলেমেয়েরা সমাজের আর্থিক ও সামাজিক নিয়মগুলো শেখে। কিন্তু এখন তা আমাদের পরিবারগুলোতে অনুপস্থিত। শহরকেন্দি ক যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে গিয়ে একক পরিবার গড়ে ওঠায় পরিবারের অভিভাবকরা উপার্জনের পেছনেই বেশি সময় দিয়ে থাকেন। সন্তান সময় পায় কম। ফলে তার নৈতিক শিক্ষা হয়ে পড়ে বইকেন্দি ক। আর সেও দেখতে থাকে তার জীবনটা রেজাল্টকেন্দ্রিক, অর্থ উপার্জনকেন্দ্রিক। ফলে ভালো মানুষ হওয়ার জোরালো ইচ্ছাটা প্রাধান্যই পায় না তার কাছে।
সরকারি কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌসি বললেন, আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। অনেক কিছুই স্বাধীনভাবে করতে পারতাম না। দাদা, বড় চাচারা খুব গোঁড়া ছিলেন। মফস্সলের কলেজের বাইরে পড়তেই দিলেন না। তাই আমার ইচ্ছা ছিল ছোট্ট পরিবার হবে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখী সংসার হবে। কিন্তু এখন আমার দুই মেয়ে যখন বড় হচ্ছে তখন বুঝি সংসারে গুরুজন কিংবা ‘মুরব্বি’ থাকাটা কতটা জরুরি। গুরুজনদের কাছে থাকলে বাচ্চারা ভদ্রতা, নৈতিক আচার-আচরণ শেখে। সারা দিন অফিস করে আমরা স্বামী-স্ত্রী তো খুব একটা সময় দিতে পারি না।
মনোবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক মোহিত কামাল বলছেন, মানুষের নৈতিকতার বিকাশ হয় তিন ধাপে। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর একটি শিশু অনুশাসন মেনে চলে শাস্তির ভয়ে। এর পর কিশোর বয়সে এসে সে নিজের স্বীকৃতি চাইতে থাকে। তার লেখাপড়া, খেলা বা যে কোনো কাজের স্বীকৃতি চায়। সে যে সমাজের রীতিনীতি মানছে এটাকে যখন মানুষ লক্ষ করে, প্রশংসা করে—সেটা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। আর নৈতিকতা বিকাশের তৃতীয় ধাপের শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়স থেকে। তখন সবাই নিজের অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে নিজের নৈতিকতার ধারণা তৈরি করে। যদি সে আগের দুই ধাপে ভালো ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠে থাকে তবে তার নৈতিকতার ধারণা ইতিবাচক রূপ নেবে। তার ধারণার জগত্ ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হতে থাকবে।
আর যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত নিয়মকানুন ভুলভাবে গড়ে উঠেছে, তখন সে তার বদল চাইবে। এই পরিবর্তনের পন্থা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। যা সে তার এত দিনের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার যুক্তি দিয়ে বিচার করবে। যদি তার বিকাশ সুস্থ, স্বাভাবিক হয় তবে তার যুক্তিবাদী মানবিক মন তৈরি হবে। যদি তা না হয় তবে তার যুক্তি হবে বিধ্বংসী, উগ্র। তখন সে উগ্রতা বা নিষ্ঠুরতাকে ঠিক বলে মনে করতে থাকবে। তাই অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের মনোজগতের বিকাশের সময়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
ইত্তেফাক/কেকে