শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নারীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে ১৪৯ দেশের মধ্যে পঞ্চম এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ

নেতৃত্বের আসনে নারী

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১২:২৪

সারা বিশ্বেই হাজারো অসংগতির মধ্যেও পুরুষের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে চলেছেন নারীরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে এ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, সবখানেই নারীর সরব নেতৃত্ব রয়েছে। যদিও তাদের নেতৃত্বের পথটি কোনোকালেই সুগম ছিল না; তবু তারা কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে পিছিয়ে থাকেননি। বাংলাদেশ আজ নারী নেতৃত্বের রোল মডেল।

বিগত বছরে করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায়ও বিশেষ অবদান রেখেছে নারী নেতৃত্ব। যে দেশের নেতৃত্ব যত দক্ষ ও জোরালো ছিল, সেই দেশ তত সহজে মহামারি মোকাবিলা করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বেই এগিয়ে রয়েছে নারী নেতৃত্বাধীন দেশশুলো। জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় যে সফলতা দেখিয়েছে, তা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মহামারি মোকাবিলায় এই সফল নারী নেত্রীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফোর্বস ম্যাগাজিন।

এই উপলব্ধি থেকে একটি নতুন ভবিষ্যত্ সৃষ্টির প্রত্যাশায় সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নারী নেত্রীরা। তারা বলেছেন, নেতৃত্বের গুণে এগিয়ে যায় সমাজ। সত্ ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণে কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে রাষ্ট্র। আর নেতৃত্ব বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সমাজে যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তার প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে। দেশে-বিদেশে এই নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে এ বছর উদ্যাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১।

আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হয়েছে—‘নারী নেতৃত্বের বিকাশ :সমতাপূর্ণ ভবিষ্যত্ গড়ার অঙ্গীকার’। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিনটি উদ্যাপন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো দিবসটি উদ্যাপনের নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মিল রেখে দেশে এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’।

বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব :বাংলাদেশের নারীরা নানা বাধা ভাঙছেন এবং পেশায় সফল হচ্ছেন। বর্তমানে দেশের সংসদনেতা, সংসদীয় উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী। নারীরা এখন উচ্চ আদালতের বিচারক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আরো অনেক কিছু হয়ে উঠছেন। আজ ২ কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছেন এবং ৩৫ লাখেরও বেশি নারী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করছেন, যা আমাদের বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্র। এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেয়েরা এখন রেলগাড়ি চালাচ্ছেন আবার গাড়িও চালাচ্ছেন। এয়ারফোর্সে মেয়েরা ভালো করছেন।

মুক্তিযুদ্ধে নারী নেতৃত্ব :বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন নারীরা। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী বা স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবিরোধীরা ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। ফলে নারীর অবদান অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। নারী মুক্তিযুদ্ধে দুইভাবে যুদ্ধ করেছেন—প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। নারীর যাত্রাপথ সরল নয়। হোক যুদ্ধদিনে বা স্বাভাবিক সময়ে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন নারী। করেছেন সাংগঠনিক কাজ, থেকেছেন রাজপথে। সেই বায়ান্নের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নারীই প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল-সমাবেশ করেছিলেন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিতে এদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছিলেন। অনেক নারী গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ১৪ জন নারী আইন পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে সক্রিয় হতে শুরু করে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি, ওয়ারী মহিলা সমিতি, আপওয়া, নিখিল পাকিস্তান সমাজকল্যাণ সমিতি। ১৯৬৪ সালে সুফিয়া কামাল, সনিজদা খাতুন, রোকেয়া রহমান কবীরের মতো নারী নেত্রীরা দাঙ্গাবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৫০০ ছাত্রী সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সুফিয়া কামাল নিজের বাড়িতে সভা করেছিলেন এবং কারফিউ চলাকালীন শহিদ মিনারে হাজার হাজার নারী সমাবেশ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অনেক নারী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নিয়মিত কুচকাওয়াজ ও প্রাথমিক চিকিত্সাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। সে সময় পল্টন ময়দানে ১০ প্লাটুন জয় বাংলা বাহিনীর এক প্লাটুন ছিলেন ছাত্রী। এই ছাত্রীদের হাতে ডামি রাইফেল ছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বাহিনী ‘বাংলাদেশ ডে’ পালন করে। এখানে মেয়েদের মধ্যে শামসুন নাহার ইকু পতাকা হাতে সামনে চলেন। ফোরকান বেগম, সাকী, কাওসার ঝুনু নেতৃত্ব দেন। তাদের সঙ্গে অন্য মেয়েরাও ছিলেন। শুধু ঢাকাতেই নয়, বিভাগীয় শহরগুলোতেও নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।


বেগম রোকেয়া দিবস উদ্যাপন ও বেগম রোকেয়া পদক-২০২০ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীদের বসিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নে সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী অনেক প্রশংসা অর্জন করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স অনুসারে আমরা নারীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছি। ১৪৯টি দেশের মধ্যে পঞ্চম স্থানে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থানে রয়েছি। আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে।’

প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরি এবং দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকেরা প্রতিবাদ করেন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন শুরু করে। তখন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদ্যাপন হয়ে আসছে।


ইত্তেফাক/এনএ