সৌদি আরবে শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যে সংস্কারের কথা ১০ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না। সৌদি আরবের ছাত্রদের বহির্জগতের সমাজ-সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত করার জন্য ভারতের রামায়ণ-মহাভারতকে সৌদি আরবে পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এটা একটা পিলে চমকে দেওয়ার মতো খবর। কট্টর রক্ষণশীল সৌদি আরবে যেখানে ইসলামি শিক্ষা ছাড়া আর কোনো শিক্ষা হারাম বা অবৈধ, দেব-দেবীর নাম উচ্চারণ করা হলে তো জিহ্বা কেটে ফেলার হুকুম, সেই দেশে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হবে তা এক কল্পনাতীত ব্যাপার।
খবরটি ছোট। কিন্তু সৌদি আরবের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ সারা মুসলিম বিশ্বে কী অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটাবে তা এখন আমরা বুঝতেও পারব না। মিশরের আল আহরাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে রামায়ণ-মহাভারত নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে। গ্রিক উপকথার দেব-দেবীর গল্প পড়ানোর ব্যবস্থা আছে।
ইংরেজ আমলে স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড়কে এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় পশ্চাদপদ ভারতের মুসলমানেরা এই শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও গোড়াতে ভারতের হিন্দু বৌদ্ধ সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে ছাত্রদের পরিচিত করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আলীগড় হয়ে উঠেছিল অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তান অর্জনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করার কেন্দ্র। বর্তমানে আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সেকুলার করা হয়েছে। তাতেও রামায়ণ-মহাভারত পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে অনেক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব হয়েছে, যেমন জামাল নাসের, কামাল আতাতুর্ক প্রমুখ। তারা সমাজ সংস্কার করেছেন, শিক্ষাকেও সংস্কার করে সেকুলার চরিত্র দান করেছেন। কিন্তু গ্রিক মিথোলজির মতো ভারতের হিন্দু মিথোলজিকেও শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়নি। যদি কেউ করেও থাকেন, তাহলেও সৌদি আরবের মতো কট্টর ওয়াহাবিজমের দেশে প্রাচীন ভারতের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে আরবের জনগণকে পরিচিত করার এই পদক্ষেপকে অবশ্যই যুগান্তকারী আখ্যা দেওয়া যায়।
সৌদি আরবে ইদানীং সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যেমন নারীদের গাড়ি ড্রাইভ করার অধিকার দান, পর্দা সংকোচন, সরকারি বেসরকারি উচ্চপদে, কূটনৈতিক পদে নারীদের নিয়োগ অনুমোদন, বেতারে, টেলিভিশনে বহির্জগতের গানবাজনার অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দান, জেদ্দাসহ অনেক শহরের স্কুলে সহশিক্ষা (coeducation) চালু করা এবং প্রকাশ্যে গানবাজনার অনুষ্ঠানে অনুমতি, এই প্রথম সিনেমা হাউস প্রতিষ্ঠায় বাধা অপসারণ ইত্যাদি। এসব কাজের জন্য কৃতিত্ব অনেকটাই ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ সালমানের প্রাপ্য।
সালমান নিজেও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি জানেন সৌদি আরব এখন আর পচা অতীতের মধ্যযুগে নেই। তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেশটি যেমন ধনী হয়েছে, তেমনি দেশটিতে সবার অলক্ষ্যে একটি শক্তিশালী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। দেশে আধুনিক শিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি স্কুল, মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এবং জনসমাজের চোখ খুলে দিয়েছে। তারা মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র দ্বারা শাসিত হতে চায় না। যদি রাজতন্ত্র দ্বারা শাসিত হতেই হয়, তাহলে সে রাজতন্ত্র যেন আধুনিক ও শিক্ষিত হয়।
সৌদি আরবে মধ্যযুগীয় অন্ধ ধর্মভিত্তিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একটি নীরব সমাজ বিপ্লব বেশ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত নারীরা তা গাড়ি ড্রাইভ করার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আদালতের বিচারে বেত্রদণ্ড, কারাদণ্ড লাভকে উপেক্ষা করছিলেন। সাংবাদিকদের অনেকে ছদ্মনামে রাজতন্ত্রের মধ্যযুগীয় চরিত্রের নিন্দা করে বিদেশে কলাম লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমা মিডিয়ায় বর্তমান বাদশার পিতার মৃত্যুর পর খবর প্রকাশিত হয়, ভূমধ্যসাগরে বাদশার বিলাসবহুল একটি সাবমেরিনে ‘হারেম’ ছিল। সেই হারেমে ছিল বিভিন্ন দেশের অসংখ্য সুন্দরী নারী। সৌদি আরবে চাকরি করতে গিয়ে বিদেশের বহু নারী কীভাবে অপহূতা হয়ে চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে গেছে সেই খবরও লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের বড় বড় কাগজে বেরিয়েছে।
সবচাইতে বড় স্ক্যান্ডাল হয়েছে সৌদি আরবে বহিরাগত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার এবং প্রখ্যাত সৌদি সাংবাদিক খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সৌদি আরবে চাকরির জন্য বিভিন্ন বৈধ অবৈধ এজেন্সির মাধ্যমে বহু বাংলাদেশি নারী-পুরুষও দেশটিতে যায়। তাদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কম নয়। অনেক নারী সেদেশে গেছেন গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করার জন্য। তাদের ওপর দৈহিক অত্যাচারসহ যে ভয়াবহ যৌন অত্যাচার হয় সে খবর জানাজানি হওয়ার পর অসংখ্য বাংলাদেশি নারী শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
ইদানীং সৌদি আরব তথা বর্তমান যুবরাজ সালমানকে সবচাইতে বেশি বিবৃত করেছে সাংবাদিক খাসোগি হত্যা। খাসোগি একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। প্রথমে রাজদরবারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। পরে রাজদরবারের বিরাগভাজন হয়ে বিদেশে চলে আসেন এবং ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখতে শুরু করেন। তার লেখা ছিল সৌদি রাজাদের সমালোচনাপূর্ণ। সৌদি গুপ্তঘাতকেরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ তদন্তের পর তাদের রিপোর্টে বলেছে, এই হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজ সালমান জড়িত।
রাজতন্ত্রকে মডার্নাইজ করা, সৌদি সোসাইটিকে সংস্কার করার লক্ষ্যে বড় বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও খাসোগি হত্যাকাণ্ডের সালমান বড় ধরনের বিপাকে পড়েছিলেন। তার ক্ষমতা দখলও ছিল জবরদস্তিমূলক। তিনি পরিবারের বহু সদস্যকে হঠাত্ আটক করেন। ব্যবসায়ীদের আটকে রেখে টাকা আদায় করেন। অনেকে বলেন, তার সংস্কার কার্যকে বাধাশূন্য করার জন্যই তিনি পরিবারের কট্টরপন্থিদের আটক করে তাদের প্রভাব ধ্বংস করেছিলেন। এর সত্যতা এখনো যাচাই করা হয়নি।
বেশ কয়েক বছর আগে সালমান যখন ক্ষমতায় আসেননি, তখন ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় এক বিরাট প্রবন্ধে বলা হয়েছিল ‘হাউস অব সউদে’ ফাটল দেখা দিয়াছে। এই রাজতন্ত্র কত দিন টিকবে তাতে সন্দেহ আছে। এই সন্দেহটি আরো জোরদার হয়, সৌদি রাজপরিবারের কন্যারা যখন অনেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর বিদ্রোহী হন এবং বিদেশে পালাতে শুরু করেন। তাদের কেউ কেউ পশ্চিমা মিডিয়ায় সাক্ষাত্কার দিয়ে সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ তুলে ধরছেন।
যুবরাজ সালমান ঠিক সময়েই সৌদি রাজতন্ত্র ও সৌদি সমাজ ব্যবস্থা সংস্কারে হাত দিয়েছেন। এ জন্য তিনি সারা বিশ্বে একজন ‘আধুনিক সংস্কারক সৌদি যুবরাজ’ বলে প্রশংসিত হতে পারতেন; কিন্তু সে পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে খাসোগি হত্যা। এই হত্যাকাণ্ড সারা বিশ্বে বিরাট ঝড় তুলেছে। এই ঝড় থেকে সালমানকে রক্ষা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। খাসোগি হত্যাকাণ্ডকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে সালমানকে তিনি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এক ঘরে হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু সে জন্য তিনি যুবরাজ সালমানের কাছ থেকে কড়া দামও আদায় করেছেন।
দামটি হলো সৌদি আরবের দ্বারা ইসরায়েলের স্বীকৃতি এবং মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন। সালমান এই চুক্তির করার পর মধ্যপ্রাচ্যের আরো আরব দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে মৈত্রী চুক্তি করেছে। ফলে আরব-সমর্থনের অভাবে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিযুদ্ধ থিতিয়ে পড়েছে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলির শত্রু রইল একটি মাত্র দেশ ইরান। সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যুবরাজ সালমান ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সব বিরোধের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্যে বাগদাদে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনাও চলছে। সালমান যদি এই উদ্যোগেও সফল হন, তাহলে পশ্চিমা জগতের কাছে তিনি হবেন হিরো। তার পরবর্তী বাদশা হওয়ার পথে কোনো দৃশ্যমান বাধা থাকবে না। হয়তো খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঝড় তিনি প্রশমিত করতে পারবেন।
সৌদি আরবে রামায়ণ-মহাভারত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণাকে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা বলা চলে। এই সিদ্ধান্ত এখন মুসলমান দেশগুলোর কোনো কোনোটাতে রক্ষণশীল মহল প্রতিবাদ তুলতে পারে। কিন্তু আখেরে এই প্রতিবাদ টিকবে না। পৃথিবী প্রগতির পথে এগিয়ে যাবেই।
আমাদের দুঃখ, সৌদি আরবের মতো কট্টর দেশে যখন বহুধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে, আমরা তখন সৌদিদেরই শিষ্য বলে কথিত হেফাজতিদের চাপে আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথের জীবনান্দ দাশের লেখা তুলে দিচ্ছি। একটু খোঁজ নিলে আমার পাঠক ভাইয়েরা দেখবেন, ব্রিটিশ আমলে নিউ স্কিম মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাতেও গোটা রামায়ণ-মহাভারত নয়, এই দুই বিশাল গ্রন্থের বহু চিত্তাকর্ষক কাহিনী—যেমন রামের বনবাসে গমন, হনুমান ও সুগ্রীবের কাহিনী, একলব্যের গুরু দক্ষিণা ইত্যাদি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু সেকুল্যার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ক্রমেই পেছনে হাঁটছি।
লন্ডন, ৮ মে শনিবার, ২০২১
ইত্তেফাক/এএএম