শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশে

আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৪০

২০০৯ সালের পর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হবে চলতি অর্থবছরে। এই সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার গত ছয় মাসে বিশ্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। দ্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশনের (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতির এমন দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর বিশ্ব অর্থনৈতিক এই মন্দার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। এতদিন আমদানি বাড়ার প্রবণতা ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে গেছে। সার্বিক আমদানির পাশাপাশি শিল্প খাতে বিকাশের প্রধান উপকরণ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও অনেক কমে গেছে।

এদিকে রপ্তানি বাণিজ্যেও চলছে মন্দা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম রপ্তানি হয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের পণ্য। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের পণ্য।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে গার্মেন্টস খাত এককভাবে ৮৪ শতাংশ অবদান রাখে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানি কমেছে পৌনে ৮ শতাংশ। আর সার্বিক রপ্তানি আয়ে এর প্রভাব পড়েছে। এই সময়ে সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এদিকে ভিয়েতনাম ও ইথিউপিয়া গার্মেন্টস পণ্যে ভালো করছে। এজন্য বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

রপ্তানি আয় ও আমদানি কমে যাওয়ায় বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার।

এদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, আমদানি ও রপ্তানির ঋণাত্মক অবস্থার কারণে অর্জিত হচ্ছে না শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি।

রাজস্ব খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আয় না হওয়া এবং বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষ হওয়ার আগেই পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে গেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। ব্যাংকের টাকা উত্পাদনশীল খাতের চেয়ে অনুত্পাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের উত্পাদনশীল খাত বা শিল্প খাতের উত্পাদন প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী, তার পরিমাপ করা হয় সেদেশের মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে। সেই বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি এখন বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরেও ৮ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে সরকার। তবে যেসব সূচকের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, তাদের বেশির ভাগই নিম্নমুখী।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক যেভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে, তাতে প্রবৃদ্ধি অনেক কম হবে বলেই মনে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার বিভিন্ন প্রভাব ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।’ ভবিষ্যতে এটা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।