শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ডাকসু :নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার

আপডেট : ০১ মার্চ ২০১৯, ২২:৫৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। সংক্ষিপ্ত নাম ডাকসু। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীকার, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে নেতৃত্ব দেওয়ার অনন্য গৌরবের সংগঠন। জাতীয় জীবনের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা- সবক্ষেত্রে সগৌরব অংশীদারিত্ব ও নেতৃত্ব রয়েছে এ ‘পাওয়ার হাউজের’ প্রাক্তন নেতা-সংগঠকদের।

স্মৃতির, গৌরবের ও নেতৃত্ব তৈরির আঁতুর ঘর সেই ডাকসুর নির্বাচন প্রায় তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। ১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) বাংলাদেশের সেকেন্ড পার্লামেন্ট কিংবা অনুসংসদ নামেও ডাকেন অনেকে। শুরুতে এর নাম ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ডাসু)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জনপ্রতি এক টাকা দিয়ে এর সদস্য হতেন। অরাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত ডাসুর বিতর্ক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো কর্মসূচিগুলোর আয়োজন, পরিকল্পনা ও পালন করাই ছিল প্রধান কাজ। ১৯৫৩ সালে ডাসু হয়ে যায় ডাকসু। নাম পরিবর্তনের মতই এর কাজের ধরন ও পরিধিতেও আসে বড় পরিবর্তন। ব্রিটিশ আমলে ১৯২২ সালে যাত্রা শুরু করা ডাসুর নেতৃত্ব ধীরে ধীরে স্বাধীকার, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ও আন্দোলনে সোচ্চার হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসু নেতারা ছিলেন সামনের সারিতেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশসহ অনেকগুলো ফ্যাক্টর ডাকসু নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। নানা কারণেই প্রায় তিন দশক ডাকসু নির্বাচন হয়নি। দীর্ঘদিনের অচল ডাকসু এবার সচল করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বগুণ বিকাশে এটি বড় ভূমিকা রাখবে।

শুরুর বিন্দু: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) যাত্রা শুরু হয় প্রথম বাঙালি উপাচার্য স্যার এ এফ রহমানের হাত ধরে। তার উদ্যোগেই প্রত্যেক হলে ছাত্র সংসদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য স্যার এ.এফ. রহমান অক্সফোর্ডের ছাত্র থাকাকালে সেখানে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর বছর ১৯২১ সাল থেকেই ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। প্রথমে হল ছাত্র সংসদ গড়ে তোলা হয়। হল ছাত্র সংসদের সাফল্যের পর ১৯২২-২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ‘ডাসু’ গঠিত হয়। ডাসুর প্রথম সভাপতি ছিলেন উপাচার্য ডব্লিউ এ. জোনকিন্স। প্রথম সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৪-২৫ কার্যবর্ষে তারা দায়িত্ব পালন করেন।

১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। এতে ছাত্র প্রতিনিধি ও মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ কর্তৃক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ছাত্র সংসদের কার্যক্রম শুধু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ছাত্র সংসদ সাধারণ মিলনায়তন পরিচালনা, বিতর্ক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। ১৯৩৯ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয়, মুসলমান হল থেকে সহ-সভাপতি হলে হিন্দু হল থেকে সাধারণ সম্পাদক কিংবা হিন্দু হল থেকে সহ-সভাপতি হলে মুসলমান হল থেকে সাধারণ সম্পাদক হবেন। সামপ্রদায়িক প্রভাবের কারণে এই সংশোধন করা হয়। আর গঠনতন্ত্রে এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে সামপ্রদায়িক বিদ্বেষের সাময়িক সমাধান মেলে। ১৯৪৪-৪৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ আরেকটি সংশোধন অনুমোদন করে। চারটি হলের প্রতিটি থেকে চারজন করে ১৬ জন এবং মেয়েদের মধ্য থেকে একজন ছাত্রী প্রতিনিধি ছাত্র-ছাত্রীরা সংসদের জন্য নির্বাচন করতে পারতেন। এ ১৭ জনের পরিষদ থেকে একজন ভিপি ও একজন জিএস নির্বাচিত হতেন।  ১৯৫৩ সালে পুনরায় গঠনতন্ত্রে সংশোধন করা হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জুন সিন্ডিকেট সভায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা প্রিলিমিনারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ডিগ্রি পাস কোর্স, বিএফএ, বিবিএ, ডিপ্লোমা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সার্টিফিকেট কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারবেন। কিন্তু এদের মধ্যে যারা কোনো কোর্সে শিক্ষাবিরতি দিয়ে পুনঃভর্তি হয়েছেন বা ফি দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছেন, তারা সে সুযোগ পাবেন না। ১৯৯৮ সালে আরেকবার ডাকসু গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ভোট গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

শুরুতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন পুরাতন কলা ভবনে ডাকসু অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ১৯৬২ সালে নীলক্ষেত সংলগ্ন কলাভবনের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে ডাকসু অফিস কলা ভবনের পূর্বদিকের নিচতলায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮০ সালে কলাভবনের পূর্ব-দক্ষিণের কোণে ডাকসুর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮২ সালে পৃথক ডাকসু ভবন নির্মাণ করা হয়।

স্বাধীনকালের সিন্ধু: বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ডাকসু এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। ডাকসুর নেতাদের সাহসী ও বলিষ্ঠ উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোট সাত বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস নির্বাচিত হন মাহবুব জামান। ১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম দুই নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান।

১৯৮২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮৯ পর্যন্ত ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ১৯৮৯-৯০ সেশনে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি’র দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ পান মুশতাক আহমেদ। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।

নেতৃত্বহীনতার তিন দশক: ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। ওই সময় কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা তাদের ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি জানান। এ নিয়ে সহিংসতায় ডাকসু নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৪ সালে ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। ফলে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালে আবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন হয়নি। তারপর ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখনকার সরকারের শীর্ষ অংশ এবং বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের বাধায় তিনি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে ব্যর্থ হন বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রদলের নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হন। এ ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে ডাকসু ভেঙে দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে। ১৯৯৭ সালের ২৭ মে সিন্ডিকেটের সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হলেও নির্বাচন আর দেওয়া সম্ভব হয়নি। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার মাসের মধ্যে আবার নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের আগেই ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত তা হয়নি। ২০০৫ সালের মে মাসে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ড. এসএমএ ফয়েজ। ওই বছর ডিসেম্বরেই ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেন তিনি। কিন্তু তত্কালীন বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচন হয়নি। তবে এ দীর্ঘকাল নির্বাচন না হলেও ছাত্র সংসদ বাবদ ফি দিয়ে আসছেন ছাত্র-ছাত্রীরা।

ডাকসুর ভিপি-জিএস ছিলেন যারা: প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মোট ৩৬ বার। ১৯২৪-২৫ কার্যবর্ষে প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। এক বছর মেয়াদকালের জন্য নির্বাচিত কমিটিগুলোর সিংহভাগই নির্ধারিত সময়সীমার বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এএম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী এবং আতাউর রহমান (ভারপ্রাপ্ত), ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম, ১৯৫৩-৫৪ সালে এসএ বারী এটি ও জুলমত আলী খান এবং ফরিদ আহমেদ (ভারপ্রাপ্ত)।

এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মোঃ ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এসএম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কেএম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।