বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাগদাদি ও সারমেয় সমাচার

আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৯, ২১:২৮

আকস্মিকই একটি সারমেয় (কুকুর) দুনিয়াব্যাপী খ্যাতিমান হয়ে উঠেছে। সেলিব্রেটিদের মতো বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই মহান সারমেয়র ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। এর স্বভাব-চরিত্র-জাত-প্রতিভা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এই সারমেয়রের কৃতিত্ব হচ্ছে, সে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদিকে হত্যার অভিযানে মার্কিন সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের মহাক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় সেই কুকুরের একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা বিস্ময়কর এক কুকুরের (বেনামি) ছবি প্রকাশ করছি, যে কিনা আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিকে ধরতে ও হত্যা করতে দুর্দান্ত কাজ করেছে।’ বেলজিয়ান ম্যালিনওয়া প্রজাতির কুকুরটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নয়নের মণি! তাকে কখনো ‘বিউটিফুল’, কখনো ‘ওয়ান্ডারফুল’ বলে টুইট করছেন ট্রাম্প।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঐ অভিযানে অংশ নিয়ে এই কুকুরটিকে নিয়ে মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মাইলি বলেছেন, ‘সিরিয়ায় জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের এই সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই কুকুরের। এত সুন্দরভাবে সে মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছে, যে-কোনো মানুষের থেকে তার দক্ষতা কম নয়। সে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধাওয়া করায় বাগদাদিকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে।’

কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, কমেডিয়ান কোনান ও’ব্রায়েনের নামে ওই মাদি কুকুরটির নাম রাখা হয়েছে কোনান। আইএস প্রধানকে তাড়া করতে গিয়ে বিস্ফোরণের তীব্রতায় আহত হয়েছিল মার্কিন ‘কে-৯’ বাহিনীর এই সেনা কুকুর। তিন দিন শুশ্রূষার পর অবশেষে নাকি সেই সেনা-কুকুর ডিউটিতে যোগ দিয়েছে।

মার্কিন সেনাবাহিনী এমনিতেই নিজেদের সুরক্ষা, শত্রু খোঁজা এবং বিস্ফোরক সন্ধানে বেলজিয়ান ম্যালিনওয়াকে ব্যবহার করে। এই প্রজাতির কুকুর অসম্ভব বুদ্ধিমান। নির্দেশ পেলে সে পলকেই হয়ে উঠতে পারে আক্রমণাত্মক! তাই এ ধরনের কুকুর গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে খুবই সাহায্য করে। এই ধরনেরই আরেকটি বেলজিয়ান ম্যালিনওয়া কুকুর ‘কায়রো’ ২০১১ সালে ওসামা বিন-লাদেনকে মারার সময়ে সঙ্গ দিয়েছিল মার্কিন নেভি সিলকে।

থাক সেসব কথা। মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কুকুর। এই প্রাণীটি একসময় বাঙালির খুবই আপনজন ছিল। রাস্তাঘাট, ফুটপাত দখল করে থাকত এ মহত্ জন্তুটি। এখন সমাজে ভিন্ন বিন্যাস। কুকুরের জন্য বরাদ্দকৃত আসন এখন দখল করে নিয়েছে টোকাই, ছিন্নমূল, হকার প্রমুখ মানবসন্তান। কুকুর এখন ধনীর ড্রয়িংরুমের আভিজাত্য। বড়োলোকদের এখন কুকুর না পাললে চলে না। ওগুলো অবশ্য ঠিক ‘কুকুর’ নয়, এদের পাপ্পি বা ডগ বলাটাই শ্রেয়। এদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী দেশি কুকুরের কোনো মিল নেই। গলায় শিকল সারাক্ষণ ‘গার্ড অব অনারের’ ব্যবস্থা, সর্বোপরি সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা—বিওয়্যার অব ডগ। কালের প্রবাহে খাঁটি বাঙালি কুকুরগুলোর (যাকে নেড়ি কুত্তা বলা হয়, অস্থি-চর্ম-হাড্ডিসার) আজ বড়োই আকাল! সেই অকারণে ঘেউ ঘেউ, লেজ নাড়ানো, সেই দল বেঁধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি অথবা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা আজ কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না!

কুকুর নিয়ে অনেকে অনেক কিছুই লিখেছেন। তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কাহিনিটি লিখেছিলেন মহামহিম সৈয়দ মুজতবা আলী। তা বিখ্যাত ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পে লাট সাহেবের তিন ঠ্যাঙে কুকুরের সঙ্গে পণ্ডিত মশাইয়ের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির যে সাদৃশ্য তিনি দেখিয়েছিলেন, তা কখনো ভোলার নয়।

কুকুর নিয়ে আলোচনা, এ নিয়ে গল্প-গবেষণার কোনো শেষ নেই। লুই পাস্তুর নামে এক বিজ্ঞানী তো কুকুরের কামড় ও এর ফলে সৃষ্ট জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে গিয়ে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় ব্যয় করেছেন। অপর এক রুশ বিজ্ঞানী পাভলভ কুকুর ও মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে সারা জীবন পার করে দিয়েছেন। এই জন্তুটি আমাদের সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আপাত নিরীহ, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাণীটি মানুষের অনেক উপকার করলেও কেন জানি বাঙালিরা গালি হিসেবেই একে বেশি প্রধান্য দিয়ে থাকে। পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব অথবা অন্য কোনো মহল থেকে জীবনে একবারও ‘কুত্তার বাচ্চা’ সম্বোধন শোনেনি—এমন অধম বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

তবে মানুষের মধ্যে কুকুরের প্রবণতাগুলোর অনেকগুলোই বর্তমান। হয়তো এ কারণেই মানুষের বাচ্চাকে আমরা... বাচ্চা বলি। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তার এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে’ (যদিও কবির এই অভিলাষের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা কারো পায়ের কাছে না বসেও খুব সহজেই অনেকের ভেতরের কুকুরটাকে দেখতে পাই। কেউ কেউ অবশ্য তার ভেতরের কুকুরটাকে লুকাতে চায়; অনেকে আবার বেপরোয়া, তারা রাখঢাকের পরোয়া করে না)!

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও কুকুরকে উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে আনা হয়। যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে একটি গোষ্ঠী ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যারা এ কথা বলেছিলেন, তারা অবশ্য নিজেরাই কামড়া-কামড়ি করে কবরে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন! থাক সেসব কথা। কুকুরের বিষয়ে বরং একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটি ভয়ংকর ভীতু কুকুর ছিল। আমরা আদর করে তাকে ‘বাঘা’ নামে ডাকতাম। ওর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যখনই সে লেজ গুটিয়ে উসাইন বোল্টের গতিতে রান্নাঘরে অথবা শোবার ঘরের চৌকির তলে আশ্রয় নিত, তখনই আমরা বুঝতাম বাড়িতে কেউ এসেছে। চোর, জামাই, মেহমান, ভিক্ষুক সবার ক্ষেত্রেই বাঘা একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত। সেটা ছিল তার এক আজব বৈশিষ্ট্য!

অনেকে দৃষ্টান্ত হিসেবেও ইদানীং কুকুরকে ব্যবহার করে। একবার একটি ‘স্পোকেন ইংলিশ’ ক্লাসে বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুফল সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক :এক বাঙালি যুবক বিলেতে লেখাপড়া শিখতে গেছে। বৈদেশিক একাকিত্ব ঘোচাতে সে তার পোষা বিড়ালছানাটিকেও সঙ্গে করে নিয়েছে। সেখানে হোস্টেলে বেশিরভাগ ছাত্রেরই রয়েছে পোষা কুকুর। গোটা হোস্টেলে বেড়াল ঐ একটিই। সেখানে ক্রমেই কুকুরগুলোর সঙ্গে বেড়ালটির সখ্য তৈরি হলো। আস্তে আস্তে বিড়ালছানাটি কুকুরের মতো কথা বলতে, চলতে-ফিরতে শিখল। দীর্ঘদিন পর ঐ যুবক দেশে ফিরে এলো। সঙ্গে বিড়ালটিও এলো। একদিন সেই বিলেতফেরত বিড়ালটি অপর একটি দেশি বিড়ালের সঙ্গে মর্নিংওয়াকে বের হলো। পথে একটি নেড়ি কুকুর বেড়াল দুটিকে আক্রমণ করে বসল। একপর্যায়ে বিলেতফেরত বেড়ালটি আত্মরক্ষার্থে রুখে দাঁড়ায় এবং ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বিড়ালের কণ্ঠে এমন নিখুঁত ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ শুনে দেশি অশিক্ষিত কুকুরটি হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং জান বাঁচানো ফরজ মনে করে দৌড় লাগায়। কুকুরের খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার পর সেই বিড়ালটি অত্যন্ত গর্বভরে তার সঙ্গীকে বলে—দেখেছ বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুফলই আলাদা!

কুকুর নিয়ে এ রকম বহু দুরারোগ্য কাহিনি প্রচলিত আছে। সেসব লিখে কারো মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না। এ বিষয়ে বরং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরে যাই। একবার আমাদের বাড়িতে এক স্বল্পপরিচিত মানুষ বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের ‘বাঘা’ ঘেউ ঘেউ করে শোবার ঘরের চৌকির নিচে আশ্রয় খুঁজছিল। এদিকে ঐ ঘেউ ঘেউ শুনে আগত ব্যক্তি ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। আমার ছোটো কাকা দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে অভয় দিলেন, ‘ভয় পাবেন না। জানেন তো, যে কুকুর বেশি ঘেউ ঘেউ করে সে কামড়ায় না।’ এ কথা শুনে ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সে তো আপনিও জানেন, আমিও জানি। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে, আপনাদের এ কুকুরটা কি তা জানে না?’

এ কথা শুনে যথেষ্ট চিন্তিত হয়েছিলাম। সত্যিই তো। এ মূর্খ কুকুরটি এসব নীতিকথা নাও জানতে পারে। তাই তো ওগুলো খামোখা উত্পাত করে বেড়ায়।

কুকুর নিয়ে মনীষীরাও অনেক কথা বলেছেন। অ্যালডাস হ্যাক্সলি বলেছিলেন, প্রত্যক কুকুরের কাছে তার প্রভু হলো নেপোলিয়ন, তাই কুকুর এত জনপ্রিয়। মার্ক টোয়েন তো দ্বিপদীয়দের সঙ্গে চতুষ্পদীয় তুলনা পর্যন্ত করেছেন। তার মতে, যদি আপনি ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার নিয়ে দেন, ভালো করে তোলেন—সে আপনাকে কামড়াবে না। বরং সেটাই হচ্ছে একটি কুকুরের সঙ্গে মানুষের প্রধান পার্থক্য।

‘সারমেয় সমাচার’ নামে এক কবিতায় কবি শামসুর রাহমান মারাত্মক কিছু কথা লিখেছিলেন, ‘ইদানীং কুকুর এবং মানুষের মধ্যে জোর/ প্রতিযোগিতার স্পৃহা বেড়ে গ্যাছে অতিশয়,/ কেউ কেউ নেড়ী কুকুরের চেয়েও অনেক বেশি ঘেউ ঘেউ করে,/ কামড়াতে আসে, নোংরা করে ঘরদোর।/ লেজ নাড়া আর পা চাটার কাজে এখন কুকুর/ মানুষ অপেক্ষা ঢের পেছনে রয়েছে,/ লজ্জা পেয়ে কুকুরেরা মধ্যপথে থেমে গিয়ে/ ‘মনুষ্য হুজুর অনেক কামেল আপনারা’, ব’লে ঠুংরি ওঠে গেয়ে।/ জগতে প্রসিদ্ধ বটে কুকুরকুলের প্রভুভক্তি;/ প্রভুর জীবন রক্ষা করার তাগিদে অকাতরে প্রাণ দ্যায় ওরা,/ কিন্তু মানুষেরা হুজুরের শক্তি থাকে যতদিন ততদিন তাঁবেদার,/ তোলে ঘরে সোনা দানা, আরো কত কিছু; প্রভুর গর্দান গেলে,/ পেছন দরজা দিয়ে পালায় কৌশলে লাশ ফেলে।’

তবে যে যা-ই বলুক, কুকুর যতই খ্যাতিমান, মহানুভব, পরোপকারী হোক না কেন, আমরা কেউই কুকুর হতে চাই না। আমরা চাই মানুষ হতে, মানুষের মতো বাঁচতে!

n লেখক :রম্যরচয়িতা