শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চামড়ায় লুকানো গোয়েন্দা যন্ত্র!

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১৩

শেখ আনোয়ার

ডিজিটাল এ সময়ে হাতের মুঠোয় স্মার্ট অ্যান্ড্রয়েড গেজেট, সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। বিশ্ব শহরে এটা ছাড়া কে, কার, কতদূর খোঁজ রাখতে পারে? এমনকি প্রিয় সন্তান যেখানেই থাকুক, টেনশন নেই। তার অবস্থান এবং কর্মতত্পরতা যখন-তখন আঙুলের ডগায় দেখে নেওয়া, জেনে নেওয়া এখন কোনো ব্যাপার নয়। শরীরে লুকানো ক্ষুদ্রাকার সেলুলার স্ক্রিনযুক্ত মাইক্রোচিপ থাকলে আর কী লাগে? এর সাহায্যে নিখোঁজ বা অস্বাভাবিক দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিকেও সহজে তাত্ক্ষণিক খুঁজে বের করা সম্ভব। ছিনতাইকারীর হাতে নগদ টাকা, ক্রেডিট কার্ড হারানোর ভয় নেই। এনআইডি, অফিসের আইডি, এমআরপি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্টুডেন্টকার্ড নামক প্রচলিত ডিজিটাল জঞ্জাল পকেটে আলাদাভাবে রাখার কোনো দরকার নেই। কেনাকাটাসহ তাবত্ দুনিয়ার সবকিছু সম্পন্ন করবে আঙুলের ডগায় লুকানো অতি ক্ষুদ্র এই যন্ত্র। শুধু কি তাই? রোগীকে যেতে হবে না ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকেও আসতে হবে না রোগীর কাছে। বাসায় বিছানায় রোগী শুয়ে থাকবেন। চেম্বারে বসে ডাক্তার জেনে নেবেন রোগীর নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ-খবর। ওষুধ বা প্রতিবিধানও দেওয়া যাবে দূর থেকে। সত্যিই কয়দিন বাদে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও, মানুষের শরীর আর নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে।

ইলেকট্রনিক মাইক্রোচিপ নামক যন্ত্রটা দেখতে ছোট্ট সরিষার দানার মতো। শরীরে বসাতে সার্জারির দরকার নেই। সিরিঞ্জের সাহায্যে হাত বা পায়ের চামড়ার নিচে সহজে স্থায়ীভাবে বসানো যায়। আঙ্গুলের চামড়ায় এই যন্ত্র ঢোকাতে সময় লাগে এক সেকেন্ড। এতে থাকা বারকোডে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েডে উদ্ধারযোগ্য যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, ছবি, ভিডিও এবং অডিও। আছে বেতার ট্রান্সমিশনের দরকারী সিগন্যাল। এসব তথ্য সেলুলার স্ক্রীন স্ক্যানারের সাহায্যে দেখা যায় এবং পড়া যায়। নতুন এই মাইক্রোচিপ গোটা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের আগামী দিনে কি এই চিপ বাধ্যতামূলক সরবরাহ করা হবে? মাইক্রোচিপের প্রস্তুতকারক কোম্পানির মতে, ‘আপাতত এটা ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের ব্যবহূত ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তদারকির কাজে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি, রক্ত, হাঁপানি, অ্যালার্জি বা হূদপিণ্ড সমস্যা রয়েছে তাদের জীবন বাঁচাতে চামড়ার নিচে বসানো এই চিপ স্বাস্থ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, এই প্রযুক্তি গ্রহণে এতদিন মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের নীতিগত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বলা হয়েছে ‘এই মাইক্রোচিপ ব্যবহার নিরাপদ বলে পরীক্ষিত হওয়ায় ব্যাপক ভিত্তিতে এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ নানান দেশের চিকিত্সা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে মাইক্রোচিপ। পাশাপাশি মাইক্রোচিপের আপডেট ক্লোন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ-তরুণীরা চামড়ার নিচে, আঙুলের ডগায় মুড়ি-মুড়কির মতো শখের বশে লাগিয়ে নিচ্ছে। এই ক্ষুদ্র চিপের সুবিধা অনেক। এটা ব্যাংকের এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ঘরে ঢোকার চাবি, গাড়ির চাবি, অফিসের আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মেডিক্যাল রিপোর্ট এমনকি পরিবহনের টিকেট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বারবার। ব্যবহারকারীদের মতে, ভবিষ্যতে এভাবেই দৈনন্দিন সব কাজে ব্যবহূত হবে ন্যানো প্রযুক্তির এই মাইক্রোচিপ ।

আর তাই, এই চিপ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সুইডেনে। সে দেশে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী চামড়ার নিচে মাইক্রোচিপ ঢোকাচ্ছে। কারণ, সুইডেন প্রযুক্তিবান্ধব আধুনিক উন্নত দেশ। দেশটাতে লেনদেনে নগদ অর্থের ব্যবহার ইতিমধ্যে একেবারে শূন্যের কোঠায়। সুইডেনের নাগরিক এরিকের কথাই ধরা যাক। এই তরুণের বাম হাতের বৃদ্ধাঙুলের ডগায় চামড়ার নিচে একটা ক্লোন মাইক্রোচিপ ঢুকানো। যেটা ব্যবহার করে সে তার ঘরের দরোজা ও আলমারির ড্রয়ার খুলে। গাড়ি স্টার্ট দেয় ও পিসি চালায়। (যেভাবে আপনি গ্যারেজের দরোজা খুলেন, অফিসে ঢুকেন, অনেকটা সেরকম। যন্ত্রটা বাসা, অফিস, গাড়ি, আলমারি ও সিন্দুকের চাবির ট্যাগের মতোই কাজ করছে।) এই চিপের সাহায্যে যে কোনো স্থানে, কঠিন ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব। বিশেষ সংরক্ষিত স্থান পরিদর্শনে মাইক্রোচিপ ট্যাগের সাহায্যে অনুপ্রবেশকারীর মন-দৈহিক ক্রিয়াকলাপ সহজে মনিটরিং করা যায়। ব্লুট্রুথ স্ক্যানারের সাহায্যে অনুপ্রবেশকারীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। যাবতীয় তথ্য উপাত্ত, ছবি ও ভিডিও স্ক্যানারে সরবরাহ করে অদৃশ্য এই চিপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে সাধারণত কড়া নিরাপত্তা বজায় রাখার নিয়ম। এই মাইক্রোচিপ বহনকারী কাউকে শনাক্ত করা বা নজরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যুত্সই জায়গা হতে পারে বলে মার্কিন প্রশাসন মনে করে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাথমিক প্রস্তাব করেছে, সেগুলো হচ্ছে—ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, হোয়াইট হাউস, নির্বাচন কমিশন, সশস্ত্র বাহিনীর ঘাটি, জনপ্রশাসন, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, পাবলিক পরিবহন সার্ভিস, কারাগার, কল-কারখানা ও পারমাণবিক স্থাপনা।

মাইক্রোচিপ তৈরি হয়েছে মূলত মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়ক যন্ত্র হিসেবে অর্থাত্ মানুষের মৌলিক কল্যাণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সার্বক্ষণিক অনুসরণকারী এই মাইক্রোচিপ দুষ্ট লোকেরা অপব্যবহার করতে কসুর করবে না। গোপনে এখানে-ওখানে ভিন্ন কৌশলে মাইক্রোচিপ ছড়িয়ে রেখে তথ্য সংগ্রহের কাজে অপব্যবহার করবে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে নিরাপত্তা প্রশাসনের ওপর পালটা নজরদারিও খাটাতে পারবে দুষ্কৃতকারীরা। তাই সাধু সাবধান!

n লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়