শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভালো হওয়া বনাম ভালো সাজা

আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ২২:০০

আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, চুপ থাকা ভালো, তাতে মানুষ ভাবতে পারে আপনি জ্ঞানী। মুখ খুলে সন্দেহ দূর করে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা চুপ থাকতে পারি না। সারাক্ষণ এটা-ওটা বলতে থাকি। অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়াই। অন্যকে নিয়ে ট্রল করি। জীবিতরা তো বটেই, মৃতরাও আমাদের নিশানা থেকে বাদ যায় না। মৃত মানুষজন নিয়ে আমরা যেভাবে ঠাট্টা করি, মনে হয় আমরা কেউ মরব না। আমরা সবাই সাধু, ওলি-আউলিয়া পর্যায়ের মানুষ। আমরা কোনো গুনাহ করি না।

আমরা সাধারণত নিজেদের দিকে তাকাই না। কেবল অন্যকে নিয়ে মেতে থাকি। কাজে যতই লবডঙ্কা হোক, ভালো ভালো কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের কোনো জুড়ি নেই। এখানে খারাপ মানুষরাও ভালো কথা বলার ক্ষেত্রে ওস্তাদ। একজন দাগি অপরাধীকে টিভি-টকশোতে নিয়ে আসুন। দেখবেন তিনিও মনীষীদের মতো কথা বলছেন। তার কথা শুনেও মনে হবে, ঠিক, তাইতো। ইস্, লোকটা মনে হয় ষড়যন্ত্রের শিকার। এত ভালো ভালো কথা যিনি বলেন, তিনি কিছুতেই এমন দাগি অপরাধী হতে পারেন না! আহ্, লোকটার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে যদি ফেসবুকে কিংবা ইনস্টাগ্রামে আপলোড করতে পারতাম!

আমাদের দেশে কেউই আসলে খারাপ হতে চান না, সবাই ভালো হতে চান। নাম চান, খ্যাতি চান। অর্থ, ক্ষমতা, ভোগ-বিলাস সবই চান। কিন্তু ভালো মানুষ হওয়ার জন্য যা করা দরকার তা অনেকেই করতে চান না। ভালো মানুষ হওয়ার সাধনা না করে ভালো মানুষ সাজতে চান। এ কারণে সামাজিক অনাচার দিন দিন বেড়েই চলছে।

এদেশে আসলে নীতিবাক্যটি হলো, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। এদেশে কিছু স্বতঃসিদ্ধ নীতি আছে। যে রাস্তায় গেলে আখেরে ভালো হবে, সেই রাস্তায় তোমার পূর্বপুরুষ তোমায় ঠেলে দিতে পারেন এবং তুমি যদি ঠিকমতো চলে থাকতে পারো তাহলেই তুমি সফল। এই পথে থাকলে তুমি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, এমপি, মন্ত্রী, ডক্টর, প্লিডার, লিডার, সেক্রেটারি, ডিরেক্টর, কাউন্সিলার, কমিশনার, প্ল্যানার। অর্থনীতি পড়বে, দর্শন পড়বে, বড় বড় কোটেশন ঝাড়বে কিন্তু সাবধান, নিজের ঘর সামলে। সমাজবাদ চাইবে, কিন্তু নিজে যে কোনো মূল্যে ধনী হওয়ার পর। ডেমোক্রেসি অবশ্যই ভালো জিনিস, উত্তম দৃষ্টিভঙ্গি, তবে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বা অটোক্রেসি বাঁচিয়ে। উপদেশ, নীতিকথা, আদর্শ সবকিছুই অন্যের জন্য। নিজের জীবনে ওসব ফলানো চলবে না। নিজেকে সব সময় ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারার বিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে। যে কোনো মূল্যে, যে কোনা উপায়ে ওপরে ওঠার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত হতে হবে। জ্ঞানের কথা, ত্যাগের কথা, আদর্শের কথা হবে মুখের বুলি, তবে নিজের জীবনে তা পালনীয় নয়। এজন্য শকুনের দৃষ্টি চাই, শৃগালের বুদ্ধি চাই, সাধকের উদাসীনতা চাই। চাই আবছা অন্ধকার। আলোচনা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠকের নামে এসবের চর্চাই বর্তমানে জোরেশোরে হচ্ছে। এটাকে বলা যায় ‘মুখে মধু অন্তরে বিষ’ নীতি। তবে এ নীতি দিয়ে আর যা-ই হোক সুন্দর সমাজ গড়া যায় না। সামাজিক অনাচারও তাতে কমে না। সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য দরকার বাইরে-অন্তরে-মুখে সবখানে মধুর সমাহার। কথায় কাজে মিল, যা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে নেই বললেই চলে। তাই তো আমরা অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে দেখি, যাদের মুখে ভালো কথার খই ফোটে, তাদের সমর্থন, সহযোগিতায়, অনেক সময় তাদের হাতেই জাতির সর্বনাশের দলিল রচিত হয়। তাইতো সভা-সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক-মতবিনিময় অনুষ্ঠানে যেসব ভালো ভালো কথা বলা হয়, শেষ বিচারে তা কতটুকু ভালো সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

তার পরও আমরা রোজ একটু একটু করে ভালো মানুষ সাজার প্র্যাকটিস করে যাচ্ছি। রোজ আমরা আমাদের ভালোমানুষি লোককে জানিয়ে দিচ্ছি। লোকে আমাদের ভালো বলছে। আমাদের খাবার হজম হচ্ছে। ঘুমও। ধীরে ধীরে ভালোমানুষির নেশা আমাদের গিলে খাচ্ছে। সকালে উঠে এক পুরিয়া ভালোমানুষি সেবন না-করলে আমাদের অস্থির লাগে। মাথার চুল ছিঁড়ি। হাত-পা বেঁকে যায়। ‘আমি’ বটিকা খুঁজি। ভালোমানুষি বটিকা।

আগে কে ভালো মানুষ সেটা জানতে বহু সময় লাগত। হয়তো বুড়ো হওয়ার পর জানা যেত যে লোকটা ভালো। রোজ একটু একটু করে তাকে ভালোমানুষি কুড়োতে হতো। লোকটা কাউকে জানতেও দিত না, সে আসলে লোক ভালো। ভালোমানুষি জানানোর তেমন উপায়ও ছিল না।

কিন্তু এখন? রোজ সকালে উঠে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা উছিলায় জানিয়ে দিই যে, আমি লোক ভালো। আমার বিবেক জাগ্রত। শেখ হাসিনা থেকে বাইডেন, করোনা ভাইরাস থেকে স্প্যানিশ ফ্লু, রোহিঙ্গা পুনর্বাসন, পথের ঘেয়ো কুকুরের ওপর নিপীড়ন সব বিষয়ে আমাদের মতামত আছে এবং সব মতামতেরই সার কথা হলো, আমি লোকটা খুব ভালো। এই ভালোর বটিকা গিলে আমি দিন শুরু করি। দু-একটা প্রতিক্রিয়া জানার পর আমি হাতে-পায়ে বল পাই। আমার শিরদাঁড়ায় একটা সুখানুভূতি কুলকুল করে বয়ে যায়। হাতে-পায়ে বল আসে। আমি দিনের বাকি কাজ বা অকাজ শুরু করি। আমি জানি, চরাচর জুড়ে যেমন খুশি ভালো মানুষ সাজার প্রতিযোগিতা চলছে। যে যেভাবে নিজেকে সাজাতে পারে, সাজাচ্ছে।

ভালোমানুষির আবার রকমফের আছে। ভালোমানুষি জানান দেওয়ার বিভিন্ন বাহন আছে। নেতার একরকম, সেলিব্রেটিদের একরকম, আমজনতার একরকম। আমজনতার ফেসবুক, সেলিব্রেটিদের টুইটার, নেতার খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেল। নেতাদের ফেসবুক না-হলেও চলে। কারণ, তারা যখন যেখানে যা বলেন, রাত্তিরে ঘুম নাই, ওঠে ঘনঘন হাই, সব দেখানো হয় চ্যানেলে, সব ছাপা হয় খবরের কাগজে। কাগজে উপরি পাওনা হলো ব্যাখ্যা। পুরো সংবাদ দুনিয়াই নেতাদের ফেসবুক। দিনভর অবিরাম ভালোমানুষির উদ্গিরণ। ভালোমানুষির স্রোতে ভেসে গেল, চুরি, দুর্নীতি, রাহাজানি। জগতে যা কিছু ঘটছে সব ভালো। সংবাদমাধ্যমে শুধু ভালোর দাপাদাপি। কে কোথায় চাষার ব্যাটার সঙ্গে নদীবাঁধে মাটি ফেলছেন, কে কবে রাস্তায় নেমে ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ কাটছেন—সব দেখানো হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। আমি ভালো। খুব ভালো।

এ বার আসুন সেলিব্রেটিদের কথায়। তাদের অব্যর্থ বাহন হলো টুইটার। বেশি লিখতে হয় না। বাইবেলের বাণীর মতো দু-একটা মহাজাগতিক মন্তব্য। ব্যস তাতেই কেল্লা ফতে। মুহূর্তে দেশের অণু-পরমাণু জেনে গেল, অমুকে এই বলেছেন। এই বলেছেন মানে কী বলেছেন? বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন, উনি লোকটা খুব ভালো। বাণী তব ধায় অনন্ত। ভালো, ভালো, উনি খুব ভালো।

এ বার আসুন আমজনতায়। এখানে আছে নানা কিসিমের লোক। কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ কবি, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি কেরানি, কেউ ব্যবসায়ী। আমরা সবাই খুব ভালো। এক সরকারি কর্মী দেখলাম লিখছেন, ‘বিনা কাজে মাসের পর মাস মাইনে নিতে আমার খুব লজ্জা লাগছে।’ বহু লোকের চাকরি গেছে, বহু লোক অর্ধেক মাইনে পাচ্ছেন, বহু লোক বুঝতেই পারছেন না, তার চাকরিটা আছে কি না। এই প্রেক্ষাপটে তার মাইনে নিতে লজ্জা লাগছে। হয়তো তার সত্যি বিবেক দংশন হচ্ছে। হয়তো তার ভাতের গ্রাস মুখে উঠছে না। কারণ এখনো আমি বিশ্বাস করি, জগতে ভালো লোক আছে প্রচুর। কিন্তু তিনি তার ‘লজ্জা’ সবাইকে জানাতে ভুললেন না। লজ্জা পেয়ে তিনি কি শেষ পর্যন্ত বেতন নিলেন না? জানা হলো না। এটা জানা গেল, তিনি লজ্জিত এবং তিনি তার লজ্জা পাওয়ার কথা সাতসকালেই জানিয়ে দিয়েছেন। আমি লজ্জিত মানে আমি ভালো মানুষ। শুনো শুনো নগরবাসী, আমি ভালো মানুষ।

আবার কারো লেখা পড়ে আপনি বুঝতেই পারবেন না, তিনি আগের দিনই সহকর্মীর চাকরি খেয়েছেন। নীল আকাশ, সবুজ বনানী, পথশিশুর কান্না, কত গানের কলি তার লেখায় গিজগিজ করছে। তার রক্তমাখা হাতে কত ভালোমানুষির হিজবিজবিজ। সকালেই উঠেই তাকে ভালোমানুষির অর্গাজম পেয়ে বসেছে। তিনি সেই ভালোমানুষির বটিকা পান করে লিখে ফেলেছেন ভালোমানুষির উপাখ্যান। আগের দিন সহকর্মীর চাকরি খেয়েছেন। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে। অতএব ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে।’

হাল্লা রাজার মতো তিনি হাত-পা ছুড়ছেন এবং থেকে থেকে বলে উঠছেন, ‘আমি খুব ভালো। আমি খুব ভালো মানুষ।’

এই ভালো মানুষরা নানা রকম কৌতুকও বানাচ্ছেন। তেমন একটি কৌতুক শুনুন।

শিক্ষক : এই পটলা, বল তো পৃথিবীতে সবচেয়ে চালাক প্রাণী কোনটি?

পটল : পৃথিবীতে সবচেয়ে চালাক প্রাণী হচ্ছে গরু।

শিক্ষক : এইটা কেমনে সম্ভব। ব্যাখ্যা দে।

পটল : ব্যাখ্যা তো আরো সহজ! বাংলা দ্বিতীয়পত্রে প্রবাদ প্রবচন অংশে আছে—অতি চালাকের গলায় দড়ি। বেশির ভাগ গরুর গলায় দড়ি থাকে। সুতরাং গরুই সবচেয়ে চালাক প্রাণী (প্রমাণিত)।

n লেখক : রম্য রচয়িতা