বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বন্ধুর হবে বাইডেনের পথ

আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫৭

ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণুবিজ্ঞানী ও পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহসিন ফখরিজাদেকে শুক্রবার বোমা ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাকে ইরানের গোপন পরমাণু কর্মসূচির পেছনে প্রধান মাথা বলে মনে করে। কূটনীতিকরা তাকে ‘ইরানে বোমার জনক’ বলে বর্ণনা করতেন। কেন এই হত্যা, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।

ব্রিটেনের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে এক বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার আগে ইরানের ওপর আঘাত হানার পথ খুঁজছেন। ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যেতে জো বাইডেনের কাজকে কঠিন করে দিয়ে যেতে পারেন।

যুদ্ধের আশঙ্কা কেন?

ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক সিমন টিসডালের মতে, নভেম্বরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে হামলা চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞরা তাতে বাধ সাধেন। তিনি আগামী ২০ জানুয়ারি বিদায় নেবেন। এর মধ্যে ক্ষমতার ব্যবহার করে ইরান নিয়ে ট্রাম্প এমন কিছু ঘটিয়ে দিতে পারেন যার জন্য পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরই মধ্যে সৌদি আরবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গোপন সফরের কথা জানা যায়। ঐ সফরে নেতানিয়াহু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে বৈঠকও করেন। বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

সৌদি আরব ঐ বৈঠকের কথা অস্বীকার করলেও মিডিয়ায় ইসরাইল থেকে নেতানিয়াহুকে বহনকারী বিমানের সৌদি আরবে গমনের কথা প্রকাশ পেয়েছে। ফলে সরকারিভাবে বৈঠকের তথ্য সামনে না আনায় ষড়যন্ত্র তত্ত্বই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঐ বৈঠকেই হয়তো ইরানকে উসকানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তেহরান ইসরাইল, সৌদি আরব কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে হামলা চালালে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালানোর একটা সুযোগ তৈরি হবে। সেটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বি-৫২ স্ট্র্যাটোফোর্ট্টেস বোম্বারু বিমানকে ৭ হাজার মাইল দূরে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কারণ এখনো জানা যায়নি। বিজ্ঞানী হত্যার এক দিন আগেই ওয়াশিংটন পোস্ট রিপোর্ট করে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সপ্তাহগুলোতে ইরাকের মাটিতে ইরানের সঙ্গে কোনো একটা সংঘাত বেধে যায় কিনা—এমন একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে ইরাকের সরকার।

ফাঁদে পা দেবে না তেহরান

ইরানের সামরিক বাহিনী বলেছে, বজ্রের মতো আঘাত হেনে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। কিন্তু ইরানের বাস্তববাদী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কথাগুলো ছিল অনেক মেপে মেপে, হিসেব করে বলা। তিনি বলেছেন, প্রতিশোধ নেওয়া হবে ঠিকই, কিন্তু হয়তো এক্ষুণি নয়। তেহরান যথাসময়ে ব্যবস্থা নেবে, ফাঁদে পা দেবে না। কোনো কোনো দেশ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, কিন্তু আমরা তাদের হাতে কী তাস আছে তা বুঝে ফেলেছি। তারা সফল হবে না। কারণ ইরান জানে, পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং সংলাপ চান।

বিবিসির বিশ্লেষক ও ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক অ্যালান জনস্টনও বলেছেন, এই সতর্কতার কারণ হলো রুহানি মনে করেন যে, ইসরাইলের কট্টর যুদ্ধবাজরা এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে ইরানের জন্য ফাঁদ পেতেছে। তারা চাইছে, ইরান একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বড় রকমের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক প্রধান জন ব্রেনান বলেছেন, ঐ বিজ্ঞানীর হত্যাকাণ্ড ছিল একইসঙ্গে অপরাধমূলক এবং অত্যন্ত বেপরোয়া, যা ঐ অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে। একাধিক টুইটে তিনি বলেছেন, ফখরিজাদের মৃত্যু নতুন করে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব উসকে দেওয়ার পাশাপাশি প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ব্রেনান আরো বলেন, তিনি জানেন না কোনো বিদেশি সরকার ফখরিজাদেকে হত্যার অনুমতি দিয়েছিল কিনা।

উভয় সংকটে ইরান

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, ইরানের ওপর চাপ বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহত হওয়ার পরও ইরান প্রতিশোধের কথা বলেছিল। কিন্তু এখনো তারা তেমন কিছু করেনি। এরপরই আবার পরমাণু কর্মসূচির এত গুরুত্বপূর্ণ এক জনকে হত্যার পর ইরানে প্রতিশোধের স্পৃহা বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্বাস আসিয়ানি বলছেন, এবার হয়তো ইরানকে কিছু একটা করতে হবে। আমার মনে হয়, ইরানের একটা জবাব দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আবার যদি ইরান কোনো পালটা ব্যবস্থা না নেয় তাহলে একইভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে হত্যা করা হবে। এভাবে চলতেই থাকবে হত্যাকাণ্ড। কিন্তু ইরানকে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই বসে থাকতে হবে। ইরানের আরো চার জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যার ধরনের সঙ্গে মোহসিন ফখরিজাদের হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে।

g বাইডেনের পথ হবে কঠিন

সিমন টিসডালের মতে, সৌদি আরবে গোপন বৈঠকে আরেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তাহলো ইরানবিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এই বার্তা দেওয়া যে, ইরানের সঙ্গে পুনরায় পরমাণু আলোচনা এবং চুক্তিতে ফিরলে মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে তাকে। মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে এক নিবন্ধে বিশ্লেষক হেনরি অলসেন লিখেছেন, ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ছয় জাতির চুক্তিতে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো বিচলিত হয়েছিল। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ইসরাইল ও উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো জানে যে, ইরান তাদের ধ্বংস করতে চায়।

অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, ইসরাইলের হাতে ইতিমধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এবং আরব রাজতন্ত্রগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের হুমকির হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে এই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের চুক্তিটি সেই আশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ইসরাইল মনে করে, এই চুক্তির অর্থ কোনো একটা সংকটের মুহূর্তে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে এমন নিশ্চয়তা আর নেই। অন্যদিকে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো মনে করছে, ইরানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন অন্য একটি পরমাণু শক্তিধর মিত্র তাদের দরকার। হয়তো তেমন একটা হিসেব মাথায় রেখেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইতিমধ্যেই ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি