বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কেমন করে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয় 

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:২৩

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস। শরীরের একটি ক্রনিক বা দীর্ঘকালীন সমস্যা। একদিনে শুরু হয় না, আবার একদিনে চলে যায় না। আস্তে আস্তে শুরু হয়, ছড়ায় এবং দীর্ঘদিন ভোগায়। আর্থ্রাইটিস মানে হাড়ের সংযোগস্থল বা জয়েন্টের কোন ইনফ্ল্যামেশন। ইনফেকশন নয়। ইনফেকশন হল শরীরে কোন জীবাণু ঢুকলে সেটি শরীরে কোন প্রতিক্রিয়া ঘটালে। ইনফ্ল্যামেশন হল কোন জীবাণু হোক, কেমিকেল হোক কিংবা শরীরের নিজের কোন কারণে শরীর পাল্টা যে প্রতিক্রিয়া করে। আর্থ্রাইটিস তেমনি শরীরের একটি প্রতিক্রিয়ামূলক প্রকাশ। আর্থ্রাইটিস খুব কমন। পুরুষ, মহিলা, এমনকি যে কোন বয়সে এটি হতে পারে।

শরীরে এমন একশো প্রকারের আর্থ্রাইটিস আছে। এগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। তার এক প্রকার হল ইনফ্ল্যাম্যেটোরি আর্থ্রাইটিস, যেখানে শুধু ইনফ্ল্যামেশন প্রধান কারণ। আর এই ইনফ্ল্যামেশন হয় একধরণের স্বয়ংক্রিয় ইমিউন রিএকশনের কারণে। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ঠিক এমন একটি অটোইমিউন ইনফ্লেমেটরি আর্থ্রাইটিস। 

ইমিনিটির কাজ শরীরকে বাহিরের জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। কিন্তু কখনো কখনো শরীর ভুল করে শরীরের কিছু কোষ, যেমন জয়েন্টের কোষকে ভুল করে জীবাণু বা বহিঃশত্রু ভেবে আক্রমণ করে বসে। এ ধরনের  আক্রমণকে বলে অটোইমিউন রিএকশন। আর এই রিএকশনের পাল্টা জবাবে শরীর নিজের আক্রমণ থেকে বাঁচতে আরেকটি রিয়েক্ট করে, যা ইনফ্ল্যামেশন। দুয়ে মিলে তখন জয়েন্টের অংশ ফুলে যায়, লাল হয়ে যায়, ব্যথা করে এবং নাড়াতে পারে না। 

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এক ধরনের ক্রনিক ডিজিজ। আর্থ্রাইটিস ছাড়াও ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, এজমা, এসবও ক্রনিক ডিজিজ। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস সহজ ভাষায় শরীরের হাত পায়ের জয়েন্টে কোন কারণ ছাড়াই ব্যথা করা, শক্ত হয়ে যাওয়া কিংবা ঠিকমতো নড়াতে না পারা। এই ব্যথার কারণে দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় শরীরের কোন সমস্যা বা পেইনকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। এক. একিউট বা হঠাৎ বা তাৎক্ষণিক; দুই. ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী। কোন পেইন বা শারীরিক সমস্যা কমপক্ষে এক বছরের উপরে চলতে থাকলে এবং তা শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে তাকে ক্রনিক কন্ডিশন বলে। 

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ঠিক এমন ধরনের একটি ক্রনিক কন্ডিশন, যা একবার শুরু হলে তার পূর্ণ আরোগ্য নেই, কিন্তু তার কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে কমিয়ে আনা এবং বিস্তার না করার ট্রিটমেন্ট আছে। 

এটি আসে, কিছুদিনের জন্যে চলে যায়। তখন মনে হয় শরীর ভালো আছে। এটি অনেক কারণেই হতে পারে। তবে ফ্যামিলি হিস্ট্রি বা জেনেটিক কারণে বেশি হয়, সাথে ধূমপান করলে। পুরুষের চেয়ে মহিলারা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগেন বেশি। 

শুরুতেই বলেছি রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস একদিনে শুরু হয় না। ধীরে ধীরে হয়। যত তাড়াতাড়ি এই স্টেজগুলোতে ট্রিটমেন্ট শুরু করা যায়, তত তার খারাপ হতে থাকা এবং তার কারণে সমস্যা গুলো থেকে শরীরকে বাঁচানো যায়। চারটি স্টেজে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ঘটে। 

সিনোভাইটিজ: এটি শুরুর স্টেজ। এই স্টেজে শরীর ভুল করে হাত এবং পায়ের, বিশেষ করে গোড়ালি, হাঁটু এবং আঙুলের জয়েন্টের সাইনোভিয়াল মেমব্রেনকে আক্রমণ করে। ফলে জায়গাটি ফুলে যায়। আক্রমণটি তীব্র নয় বলে এই স্টেজে মাইল্ড পেইন করে। 

পিনাস: এটি দ্বিতীয় স্টেজ। এই স্টেজে শরীর জয়েন্টের কার্টিলেজ অংশটিকে আক্রমণ করে বসে। কার্টিলেজের কাজ জয়েন্টে কুশনের মতো কাজ করা, যাতে হাড়ে হাড়ে ঘষা না লাগে। এই স্টেজে কার্টিলেজ ঠিক মতো কুশনের কাজ করে না, শক্ত হয়ে যায়, ক্ষয় হতে থাকে। ফলে হাড়ে হাড়ে ঘষা লাগে মুভ করলে, আর তাতে ব্যথা করে বেশি। এই স্টেজে কার্টিলেজ ক্ষয়ে গিয়ে হাড়েরও ঘষা লেগে ক্ষয় বেড়ে যেতে থাকে। 

ফাইব্রাস এনকাইলোসিস: এটি তৃতীয় স্টেজ। এই স্টেজে জয়েন্টের কুশন বা কার্টিলেজ পুরোপুরি ক্ষয়ে যায়, হাড়ে হাড়ে ঘষা লেগে এমন অবস্থা হয় যে জয়েন্ট আর সহজে মুভ করতে পারে না, জায়গাটি শক্ত হতে থাকে, এমনকি বাঁকা হতে থাকে। এই স্টেজে সামান্য মুভ করলেও জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা করে। 

বনি এনকাইলোসিস: এটি শেষ স্টেজ। এই স্টেজে জয়েন্ট বলে কিছু থাকে না। হাড়ের ভেতর হাড় ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। এই স্টেজে ব্যথা কমে যায়, কিন্তু শরীরের স্বাভাবিক চলা ফেরা থেকে সামান্য মুভ করাও কষ্ট সাধ্য হয়ে যায়।

যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা, ব্যায়াম, ব্যালেন্সড ডায়েট ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করে তা ধরে রাখা যায়, তত তার পরবর্তী স্টেজে চলে যাওয়ার হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করা, সমস্যাগুলোকে কমিয়ে আনা এবং দৈনন্দিন জীবনকে পেইন ফ্রি করা যায়।

লেখক: চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক। 

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন