বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

টেসলায় যোগ দিলেন বাংলাদেশি সামসুল আলম

একটা সময় গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার গড়া ছিল অকল্পনীয় বিষয়। সেই চিত্র এখন অনেকটাই বদলেছে। প্রতিবছর অসংখ্য বাংলাদেশি যোগ দিচ্ছেন এসব প্রতিষ্ঠানে। এবার আরও এক স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান টেসলায় যোগ দিলেন এক বাংলাদেশি, যার নাম সামসুল আলম সরকার। এখন তিনি অবস্থান করছেন কানাডার উইন্ডসর শহরে। টেসলার সিনিয়র প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সামসুলের সাথে কথা বলেছেন তানভীর তানিম

আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:৪৪

সামসুল আলম সরকারের জন্ম নরসিংদীর পশ্চিম ভেলানগরে। বাবা মো. সেকান্দর আলী ছোটখাটো চাকরি করতেন। মা রহিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। সামসুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি চিনিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ব্রাহ্মন্দী কেকেএম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে এসএসসি এবং ১৯৮৯ সালে এইচএসসির পর চলে আসেন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। ১৯৯৩ সালে তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। সেখানে স্নাতক সম্পন্ন করে চলে যান কানাডায়। সর্বশেষ উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছেন।


কর্মজীবন
কর্মজীবনে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সামসুল। শুরুটা ১৯৯৭ সালে। ডুয়েট থেকে স্নাতক শেষ হবার সাথে সাথেই ডাক পান পার্টেড গ্রুপে। সেখানে এক বছর কাজ করে যোগ দেন জিওলজিক্যাল সার্ভে ইন বাংলাদেশ-এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। পরবর্তীতে সেখানেও স্থায়ী হননি। একই বছর বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। 

২০০৫ সালে সবকিছু ছেড়েছুড়ে তিনি যাত্রা করেন কানাডার উদ্দেশ্যে। উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ হতেই পেয়ে যান গবেষণা সহকারীর কাজ। পরবর্তী সময়ে ইউএস ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন, টাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ইয়ানফেং অটোমেটিভ ইনটেরিয়র্স এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করেছেন নিয়মিত। সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে টেসলায় সিনিয়র প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরির সুযোগ পান।


স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে যোগদান
গত বছরের জুলাই মাসে টেসলা থেকে একটা বার্তা আসে সামসুলের কাছে। টেসলার প্রতি তার কোন আগ্রহ আছে কিনা জানতে চাওয়া হয় সেখানে। সম্মতিসূচক উত্তর জানাবার পর শুরু হয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। তিন-চার ধাপে অক্টোবর পর্যন্ত চলে এটি। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০২১ এর নভেম্বরে সুখবরটি পান সামসুল। সিনিয়র প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি মনোনীত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, টেসলার স্বপ্নের প্রকল্প ইলেকট্রনিক গাড়ি তৈরি দলের গর্বিত সদস্য হবারও সুযোগ পেয়েছেন তিনি।


অর্জন
১৯৯২ সালে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন সামসুল। ১৯৯৮ সালে পিএসসি’র অধীনে জিওলজিক্যাল সার্ভে ইন বাংলাদেশ এর নিয়োগ পরীক্ষায় অর্জন করেন প্রথম স্থান। সাফল্যের অগ্রযাত্রা এখানেই শেষ নয়। ২০০৮ সালে উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে কো-অপ (সমবায় শিক্ষা) করেন। এর মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কো-অপ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি।


ব্যক্তিজীবন
বাবাকে হারিয়েছেন ২০১৪ সালে। এরপর মা'কে নিয়ে স্থায়ী হয়েছেন কানাডার উইন্ডসরে। বর্তমানে মা, স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে সুখে দিন কাটছে তার। তার বড় মেয়ে এবার গ্রেড-৯ এবং ছোট মেয়ে গ্রেড-৭ এ লেখাপড়া করছে।


সাফল্যের চাবিকাঠি
জিওলজিক্যাল সার্ভের নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় সামসুলের মধ্যে। নিজেই অনুধাবন করেন, তার যোগ্যতা কারো থেকে কম নয়। এরপর উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে কো-অপ এর চার মাস ছিল তার জীবনের দর্পণ। সেখানে কাজ করতে গিয়েই উপলব্ধি করেন নিজের সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতির সবটুকু। এরপরই নিজেকে পুরোপুরি ভেঙে গড়েছেন সামসুল। তাই তো আজকের এই সাফল্য—এমনটাই মনে করেন তিনি।


যাদের অবদান উল্লেখ করতে চান
নিজের সাফল্যের পিছনে চারজন মানুষের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সামসুল। তারা হলেন তার বাবা-মা, স্ত্রী এবং উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানিয়েল গ্রীন। কানাডাতে যাওয়ার খরচ যোগাতে নিজের পেনশনের পুরোটাই দিয়ে দেন বাবা সেকান্দর আলী। আর অচেনা বৈরি পরিবেশে পড়ালেখা করায় উৎসাহ দিয়ে পাশে থেকেছেন তার স্ত্রী ফেরদৌস জাহান দিলরুবা। অন্যদিকে, অধ্যাপক গ্রীন তাকে গবেষণার সাথে সাথে একটা মোটা অঙ্কের বেতনের ব্যবস্থা করে দেন। যা ছিল তার জীবনের অন্যতম পাওয়া।


অনুভূতি
টেসলাতে যোগদানের অনুভূতি অনন্য ও অসাধারণ বলে মনে করেন সামসুল। তিনি বলেন, পুরোটা সময় এক্সাইটেড ছিলাম, ভালোলাগা কাজ করছিল। সেই ভালোলাগা আরও হাজার গুণ বেড়ে গেল, যখন অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে শুনতে পেলাম সেই অমোঘ বাণী, 'উই আর বেস্ট এন্ড উই হায়ার দ্য বেস্ট। অল অফ ইউ আর দ্য বেস্ট পিপল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড!'


দেশ নিয়ে ভাবনা
প্রবাসে থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। নিয়মিতভাবে খোঁজখবর রাখেন দেশের। এদেশের তরুণরা কী করছে, কোন অবস্থায় আছে সেসব বিষয়ে তার প্রবল আগ্রহ। মন থেকে সবসময় চান, বাংলাদেশের তরুণরা ভালো করুক, বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার গড়ুক। সেই লক্ষ্যে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র (বিটাক) এর সাথে ডুয়েটের সমঝোতা চুক্তি করার আগ্রহের কথা জানালেন তিনি। তার মতে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি দেশসেরা বা বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে থাকতে পারে, তাহলে ডুয়েট কেন পিছিয়ে থাকবে! 

ইত্তেফাক/এসটিএম
 
unib