শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

তারুণ্যের ভাবনায় নারী দিবস

আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 'টেকসই আগামীর জন্য লিঙ্গ সমতা'— এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে এবারের নারী দিবস উদযাপন করা হচ্ছে।  বাংলাদেশে নারীসমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতার উন্নয়নের জন্য দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। নারী দিবস নিয়ে 'প্রজন্ম'-এর সঙ্গে আলাপে কয়েকজন তরুণ তাদের ভাবনার কথা জানিয়েছেন। গ্রন্থনা করেছেন তানভীর তানিম, মো. আবু রাহাতশাকিরুল আলম শাকিল

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ১৩:৩৪

একটা দেশে নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তাকে যখন তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়, তখনই বোঝা যায় দেশে নারী অধিকার কতটুকু নিশ্চিত। সবচেয়ে বেশি অবাক লাগে যখন কেউ বলে, নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস নাই কেন? সামাজিক মাধ্যমে এসব কমেন্টই হল নারীদের দুর্দশা সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রকাশ। 
আমি মনে করি, নারী দিবস উৎযাপন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিভিন্ন অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ, কর্মজীবী অনেকে আছেন, যাদের বাইরের মেয়েদের প্রতি এক রকম আচরণ, আর নিজের পরিবারের মেয়েদের সাথে অন্যরকম। তাদের মানসিকতার পরিবর্তনে নারী দিবস উৎযাপন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আজকাল কিছু কিশোর ও তরুণদের মধ্যে প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষ দেখা যায়। ছেলেরা তো বটেই, এমনকি মেয়েদের মধ্যেও। নারীবাদের ব্যাপারে ভুলভাল জানার কারণে, ‘নারীবাদী’ শব্দটা অনলাইনে এখন একটা গালি। নারী দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবার বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ আমাদের তরুণদের নারীবাদ বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দেবে।
তাই আমার মতে, প্রতিবছর নারী দিবসে ছেলে-মেয়ে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেশের পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন করে নারীর প্রতি সহিংসতা, অবমূল্যায়ন, ধর্ষণের মত ঘটনা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
সুবহা সামউন, শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 


প্রতিটি দিবসই কোনো না কোনোভাবে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে ৮ ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, নারী দিবস মানে হচ্ছে নারী এবং নারীকেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে তুলে ধরার একটা প্রয়াস। নারী তার অধিকার আদায়ে কতটা সংগ্রামী তা বিশ্বকে জানান দেওয়ার একটা বিশেষ পন্থা। একজন নারী চাইলেই তার সুনিপুণ কর্মদক্ষতা দ্বারা একটা জাতিকে সুশীল ও সুদক্ষ এবং একটি দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে নারীরা পদচারণ করেনি। ঘর সামলানোর কাজ থেকে শুরু করে, কোট-কাচারী, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি দেশ চালনার মতো কঠিন কাজেও নারীরা পিছিয়ে নেই। কিন্তু, আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে নারী উন্নয়নের প্রধান বাধা 'পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি' যা মোটেই কাম্য নয়। এখনো কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হয় যা একটা দেশের উন্নয়নের বাধা হতে পারে। 
আমার মতে, একটা দেশ তখনই স্বাবলম্বী হয়ে উঠে যখন সেই দেশের নারী এবং পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সু্যোগ পায়। নানান ক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও উন্নয়নমূলক প্রতিটি কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করছে যা প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমার তথা একজন নারীর একটাই চাওয়া সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা যেন নারীর উন্নয়নের পথকে আরো মসৃণ করে তোলে।
মেহজাবিন ইমা, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 


নারী কখনো মা কখনো বোন আবার কখনো স্ত্রী। এভাবে একজন নারী তিনটা ভূমিকা পালন করে থাকে। একটা বাড়ির মূল হচ্ছে নারী। কথায় আছে, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। এ রমনীকে যদি সঠিক মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে সে সংসার কখনও উন্নত হতে পারে না।
শিশুর প্রথম শিক্ষক হচ্ছে তার মা। মা ছাড়া শিশু কখনও বিকশিত হতে পারে না। নেপোলিয়নের কথায় আসি, তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, একজন নারী জাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমাদের দেশে নারীদের ঘরবন্দী করে রাখার চেষ্টা করা হয়। কখনও কখনও তাদের উপর করা হয় অমানষিক নির্যাতন। নারী হচ্ছে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক। এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরবন্দী করে উন্নয়ন কখনও সম্ভব না। 
তবে এখন নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউ-বা ব্যবসায়ী হচ্ছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। নারী দিবসে সকল নারীকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তারা গৃহবন্দী না থেকে বের হয়ে আসবে, উন্নয়নে ভূমীকা রাখবে। সকল নারী বেঁচে থাকুক মানুষ হিসাবে নারী দিবসে এই কামনা করি। মধ্যযুগের মতো বন্দী না থেকে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখুক। সকল নারীকে আবারও নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। এ দিবসে তারা বন্দীর শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসুক এই কামনা করছি।
রকিবুল হাসান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ 

 

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীরা আজ পৌঁছে গেছেন বিমানের ককপিট থেকে পর্বতশৃঙ্গে। দশভুজা নারী ঘরে-বাইরে নিজেকে আলোকিত করছেন প্রজ্ঞা আর মেধায়। নারী স্বাধীনতার মূল বিষয়গুলো শুধু গ্রন্থেই বন্দী হয়ে থাকার জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন জরুরি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমরা অনেকেই উঁচু গলায় নারী স্বাধীনতার কথা বলে থাকি, কিন্তু আমরা আসলে নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝি না। সমাজকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, নারীর প্রথম পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। তাই নারী জ্ঞান অর্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, সেবা, দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে মানসিক দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল ভেঙে এগিয়ে চলতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্যাতিত সকলের আত্মসম্মানবোধের চেতনা জাগ্রত হোক, মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত হোক, সকলের অধিকার পূর্ণতা পাক।
দুর্জয় কুণ্ডু, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

নারীদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে এবং নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উৎসাহ প্রদানে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। কিন্তু নারীরা শুধু এই দিনটিতেই নয় বরং বছরের প্রতিটি দিনেই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য-এই বিবেক আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। নারীরা যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার হয়, ঠিক সেভাবেই তারা পুরুষের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। আমি পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে নারীদের এই স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত। অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের হার ও প্রভাব উভয়ই বেশি।  বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে নারীদের প্রজনন-স্বাস্থ্যের উপর। শব্দ দূষণজনিত কারণে নবজাতকের শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি খুবই প্রচলিত সমস্যা। তাছাড়া বায়ুতে বিদ্যমান দূষক কণার উপস্থিতিতে হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টজনিত অসুখের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে নারীদের ডিম্বাণুর সংখ্যা ও উর্বরতা। নারী দিবস উদযাপনের এই দিনে তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণজনিত কারণে নারী স্বাস্থ্য অবনতির বিষয়টি আবারও সামনে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
মারুফা ইয়াসমিন রিতু, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্

 

পুরুষতন্ত্র নারীকে যুগ যুগ ধরে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছে। নারীর চিন্তা, সুখ-দুঃখ বা স্বাধীনতা নিয়ে ভাবেনি কেউ। তবুও পুরুষতান্ত্রিক বা সামাজিক কোন নিয়ম, দুঃশাসন, অবিচার দাবিয়ে রাখতে পারেনি তাদের। নারী বসন্তের কচি কিশলয় হয়ে শীতের রুক্ষতাকে জয় করতে শুরু করেছে, ফুল হয়ে ফুটছে বিস্তীর্ণ বিরাণ ভূমিতে। যে সাহিত্য-সংস্কৃতি একসময় শেক্সপিয়ার, জন কিটস কিংবা রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভার্জিনিয়া উলফ, টনি মরিসন, বেগম রোকেয়ার মতো নারীরা। নারী শক্তিতে এগিয়ে চলছে বিশ্ব। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নারীরা এখন দর্পের সাথে দায়িত্বপালন করে যাচ্ছে। নারীদের সুশাসনে ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্রের দুঃশাসন। নারী অধিকার আদায় একটা যুদ্ধ৷ এই যুদ্ধে জয় তখনই সম্ভব যখন নারীরা নিজেদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবে। আর এগিয়ে যাবে- "কখনো হয়ে অগ্নি, কখনো জল কখনো হয়ে ফুল, বাহুতে নিয়ে বল।"
রাকিব হাসান রাব্বি, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্

 

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন