বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে

আপডেট : ১০ মে ২০২২, ১০:১৭

সংস্কৃতি সভ্যতাকে ধারণ করে, বয়ে নিয়ে চলে। বলা চলে সংস্কৃতি সভ্যতা থেকেও বৃহৎ। কারণ সভ্যতার উৎথান পতন আছে, হ্রাস-বৃদ্ধি-ক্ষয় আছে আর সংস্কৃতি চিরঅম্লান। প্রবাহমান নদীর মতো— রূপান্তর আছে কিন্তু মৃত্যু নেই। সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে বহন করে, আচার-আচারণকে প্রভাবিত করে। কখনো দৃশ্যমান ভাবে, কখনো অন্তর্নিহিত হয়ে। সংস্কৃতির বেশ কয়েকটি ধারা আছে। এর যে ধারাটি কোনো দেশ, সমাজ বা জাতির আত্মপরিচয়কে ধারণ করতে পারে, সেখানে বসবসরত জনগোষ্ঠীর ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য, পেশা, আচার-বিশ্বাস, মনন-রুচি, ভূয়োদর্শন, শিল্পবোধের নিদর্শন, নীতি-নৈতিকতাকে ফুটিয়ে তোলার সক্ষমতা রাখে তা হলো লোকসংস্কৃতি।

লোকসংস্কৃতি হলো কৃত্রিমতা বিবর্জিত সহজিয়া একটি সুর—যা সমাজব্যবস্থার মূল সুরকে খাদমুক্ত করে তুলে ধরে। আবহমানকাল থেকে নদনদী ও কৃষিজীবন বাংলার সংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। গ্রামকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থায় গ্রামীণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, আচারঅনুষ্ঠান, সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পবোধে আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রধান নিয়ামক হিসাবে ভূমিকা পালন করে এসেছে। আমাদের লোকগান, উৎসব, প্রবাদ-প্রচারণ, সাহিত্য, লোককথার দিকে তাকালে তার-ই প্রমাণ মেলে। পূর্বে আলোচিত হয়েছে সংস্কৃতির মৃত্যু নেই। তাহলে লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন? সংস্কৃতির উপাদানসমূহ যেহেতু জীবনঘনিষ্ঠ তাই জীবনবোধের পরিবর্তন বা বিপর্যয় ঘটলে সংস্কৃতির উপাদানসমূহেরও রূপ কিছুটা পালটে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে পুরোটাই বদলে যায়। তখন সংস্কৃতির যাত্রাপথের বদল ঘটে, রূপান্তর হয়। আমাদের লোকসংস্কৃতি এখন যেন সেই পথেই এগোচ্ছে।

সম্প্রতি কয়েক দশকে আমাদের লোকসংস্কৃতির আশঙ্কাজনকভাবে বিলুপ্তি ঘটেছে। বন্ধ হয়েছে চর্চা। আরো ভয়ংকর বিষয় হলো লোকসংস্কৃতিতে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়েছে। বিভেদ বেড়েছে। সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য নিশ্চয় বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেই বিচিত্রতা যদি বিভেদ সৃষ্টির উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। লোকসংস্কৃতির সর্বাধিক শক্তিমান মাধ্যমটি হচ্ছে গান। জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, দেহতত্ত্ব, মরমি, ধর্মাশ্রিত কীর্তন, আধ্যাত্মিকসহ অজস্র লোকসংগীতে সমৃদ্ধ আমাদের লোকসংস্কৃতি। এই সংগীত জুড়ে ভর করে ব্যক্তি জীবনের আনন্দ, বেদনা, হতাশা, প্রেম, বিরহ, দেহকেন্দ্রিকতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি।

লোকসংস্কৃতির আরেকটি ঐশ্বর্য—গ্রামীণ খেলাধুলা। অতীতে কত ধরনের খেলা যে গ্রামীণ জীবনকে নির্মল বিনোদন ও সুখময় করে তুলত— সে- পরিসংখ্যান নিলে বেশ আশ্চর্য হতে হয়। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বুড়িছি, হাডুডু, এক্কাদোক্কা, কাবাডি, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, পুতুলনাচ ইত্যাদি খেলা ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অতীতে যাত্রাপালা হতো, পূজা-পার্বণে মেলা বসত, সন্ধ্যা হলে খোলা আকাশের নিচে গল্পের আসর বসত; উন্মুক্ত আলোচনা চলত। এ সব-ই হলো লোকসংস্কৃতির এক-একটি উপাদান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লোকসংস্কৃতির প্রবল এই উপাদানগুলো এখন ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে। তাদের জৌলুস, প্রচার-প্রসার সবই কমেছে। কিছু কিছু তো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

হাজার বছর ধরে লালন করে আসা লোকসংস্কৃতির এত-এত ধারা আজ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? তার কারণ কি কেবল যুগের আধুনিকায়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির রমরমা ব্যবহার? এখন গ্রাম্যজীবন যেমন অবহেলিত; গ্রামীণ মানুষ যেমন অবহেলিত; লোকসংস্কৃতিও ঠিক তেমনি অবহেলিত। অবহেলায় লোকসংস্কৃতির সহজ-সরল ধারা আজ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে উপনীত হচ্ছে। শহরের জগাখিচুড়ি সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে লোকসংস্কৃতির দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।

এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শক্তি। এ ছাড়া গণমাধ্যম যেমন রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্র ইত্যাদির কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতিকে শুধু দূরে ঠেলে দিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে ‘শত্রুর’ ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম-সংস্কৃতির ধারাকে বেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে; সে কারণে এসবের ওপর সংস্কৃতির বিকাশও নির্ভরশীল। কেবল আধুনিকায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা টিভি, সিনেমার মাধ্যমে বয়ে আসা আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবকে আমাদের নিজেস্ব লোকসংস্কৃতি ধ্বংসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করলে অন্যায় হবে। পাশাপাশি আমাদের প্রচেষ্টা, ইচ্ছাশক্তি ও সংস্কৃতি বিমুখ মন-মানসিকতাকেও দায়ী করতে হবে। সময়ের পরিবর্তন হবে। জীবন ধারণ ও প্রাত্যহিক কাজের রূপ বদলাবে। কিন্তু স্বীয় সংস্কৃতির শিকড় ভুলে গেলে চলবে না। পরিবর্তনের সূত্র মেনে আধুনিকায়নের ছোঁয়া দিয়ে তাকেও আগলে রাখতে হবে। তবেই জাতীয় জীবনে সত্যিকারের উৎকৃষ্ট অবস্থা ফিরবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ড্রাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন