শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাংলাদেশের পর্যটনসেবা ও নিরাপত্তা 

আপডেট : ১২ মে ২০২২, ০৮:২৫

২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ নামে বিজ্ঞাপনটির নির্মাতা বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রণালয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন নারী পর্যটক বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন। পুরোটা সময় তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ মানুষেরা তাকে গ্রহণ করেছে পরম মমতায়। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের কাছেও তিনি চমৎকার আতিথেয়তা লাভ করলেন। ফিরে যাওয়ার সময় তাঁতে বোনা একটা গামছা তিনি নিয়ে যান পরম যত্নে। এয়ারপোর্টে বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালক তাকে বিদায় জানালেন যেন খুব কাছের প্রিয় মানুষের মতো। 

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার উলটো। জাফলংয়ে স্থানীয়দের হাতে এক নারী কীভাবে নজিরবিহীন হেনস্তার শিকার হলেন তা আমরা দেখেছি। কয়েক বছর আগে এক নারী পর্যটক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি তুলেছেন। মাসখানেকের সফর শেষে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে তার প্রিয় ক্যামেরাটি হারান। পরে ঘটনাটি আলোচনার জন্ম দিলে পুলিশের তৎপরতায় ক্যামেরাটি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ক্যামেরার মেমোরিটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যথিত হৃদয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। কক্সবাজারে গত বছরও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী।

বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে এমন ঘটনার নজির একেবারেই নতুন নয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখেছি, এক পর্যটকের ভিডিওতে স্থানীয়রা হাসি-তামাশার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় ভাষায় মারাত্মক কিছু গালি আওড়ে যাচ্ছে। আমাদের সমুদ্রসৈকত বা স্পটগুলোতে একাকী নির্বিঘ্নে ঘোরার জো নেই। পুরোটা সময় স্থানীয়রা তাদের ঘিরে ধরে, ছবি তুলতে চায়, আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তো আছেই। স্থানীয়দের ধারণা, পর্যটকরা আসেন টাকার থলি নিয়ে। তাই স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন পণ্যেরও আকাশচুম্বী দাম হাঁকান তারা। ধরুন কক্সবাজার থেকে ইনানী বিচ দেখতে যাবেন কিছু পর্যটক। চান্দের গাড়ি নামের বিশেষ গাড়ি ভাড়া করতে গেলে দেখা যাবে মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরত্বের এ পথের ভাড়া ১০-১২ হাজার। একটু দরকষাকষি করলেই তা নেমে আসবে ৩ হাজারে। পর্যটন মৌসুমে কোনোভাবেই ৫ হাজারের কমে সেখানে যাওয়া যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সেখানে সত্যিকার ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পর্যটন বিভাগ থেকে করা হয়েছে কি না।

ঢাকা থেকে একজন পর্যটক কক্সবাজার যেতে চাইলে যাত্রাবিরতি থেকে শুরু করে হোটেল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তাকে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। এখানে প্যাকেটজাত পণ্যের দামও বেড়ে যায় অলৌকিকভাবে। জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমাদের এখানে এই নিয়ম। পর্যটকরাও মানতে বাধ্য। সেই সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে টিকিট বাণিজ্য। সে টিকিটের বিনিময়ে পর্যাপ্ত টয়লেট বা বিশ্রামাগারও নেই। পর্যটন স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশসেবা চালু হয়েছে। দেশের প্রধান পর্যটনস্হল কক্সবাজারে ১ হাজার ২৫০ জন পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে মাত্র একজন পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা তো আছেই। লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তায় আছে মাত্র ২১১ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ। হিমছড়ি, রামু, সোনাদিয়া, সাবরাং, টেকনাফসহ বহু স্থানে পর্যটকের নিরাপত্তায় কেউ নেই। ২০১৫ সালে বিদেশি এক নারী পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোতে মানসম্মত খাবার পাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থানীয়দের দৌরাত্ম্য। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের বেলায়ও তারা বাড়তি দাম নিচ্ছে। মোট কথা, প্রতিটি পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয় পর্যটকদের। উদাহরণ হিসেবে কক্সবাজারের কথাই ধরা যাক। এখানে সামুদ্রিক মাছের বেশির ভাগই মানসম্মত নয়। বার্মিজ মার্কেটে বিক্রি হওয়া চকলেট-আচারের বেশির ভাগই ভেজাল। শুঁটকির বাজারের দাম প্রায় ঢাকার সমান, গুণগতভাবেও তা ভালো নয়।

বিদেশি এক পর্যটকের নিউ মার্কেটে দরকষা-কষির চিত্র দেখলাম ইউটিউবের কল্যাণে। ভদ্রলোক আগেই হয়তো ভালো স্টাডি করে এসেছেন। তাই পরিস্থিতি ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছেন। আবার বিদেশি এক দম্পতির রেলভ্রমণের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের কেবিনে ঢুকে তারা দেখলেন সেখানে বিশ্রামের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আর টয়লেটের কথা তো নাইবা বললাম। পরে তাদের জন্য তোড়জোড় করে কম্বল বালিশের ব্যবস্থা করে দেয় স্টেশন মাস্টার। সুবিশাল সৈকত, পাহাড়, সুন্দরবন, বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থাকলেও দেশে বিদেশি পর্যটকের হার হতাশাজনক। এমনকি বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে পর্যটকরা ভিসার জন্য গেলে তাদের নিরুত্সাহিত করার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অন-অ্যারাইভাল ভিসা চালু হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো হয়নি। ফলে বিদেশিদের ভিসা পেতে বাংলাদেশের দূতাবাস অথবা হাইকমিশনে যেতেই হবে।

বাংলাদেশে বছরে কত জন বিদেশি পর্যটক আসেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ কোটিরও বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক হতে পারে বড় জোর বছরে ৩ থেকে ৫ লাখ। করোনার পর সংখ্যাটা আরো কমেছে। যেখানে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি পর্যটন খাতের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে মোটামুটি ব্যর্থই আমরা। তবে বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশে আসতে প্রথমেই যে বাধার ?মুখে পড়ছেন তা হলো ভিসা। ভিসার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। এতে অনেকেই বাংলাদেশে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান পর্যটন খাতে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে শুধু কিছু হোটেল-মোটেল নির্মাণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। পর্যটকদের যাতায়াত, নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ সবকিছুর বন্দোবস্ত থাকা আবশ্যক। শহর, নগরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই কেবল পর্যটন খাতে ভালো ভবিষ্যৎ আশা করা যেতে পারে। স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ সেবা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। যেসব স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সঙ্গে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন