বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

কীভাবে ফেরানো যাবে পি কে হালদারকে? 

আপডেট : ১৭ মে ২০২২, ০৮:০২

অন্তত সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ভারতে গ্রেফতারের পর থেকেই আলোচনা হচ্ছে, কীভাবে তাকে ফেরানো যাবে? কতদিন লাগবে? সরকারের তরফ থেকে তাকে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে আইনি পথেই দেশে ফেরানোর আশা করা হচ্ছে। তবে কতদিন লাগবে, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি বেআইনিভাবে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সেই কারণে যদি ভারতের কর্তৃপক্ষ আলাদা মামলা করে বিচার শুরু করে, তাহলে বিচার শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। পাশাপাশি অর্থ পাচারের মামলা হলে সেটার বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান মনে করেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে তাকে দেশে ফেরাতে অন্তত তিন থেকে চার মাস লাগতে পারে। তবে কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান মনে করেন, তাকে ফেরাতে ছয় মাসও লেগে যেতে পারে। বেশিও লাগতে পারে। কারণ তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নাগরিকত্ব নেওয়ার অভিযোগে ভারতে বিচার শুরু হলে সেটি সময়সাপেক্ষও হয়ে উঠতে পারে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পি কে হালদারকে সেখানে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা দপ্তর ইডি আদালতে  যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেখানে তাকে বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে।

২০১৩ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি হয়। সেই চুক্তির আলোকে কয়েক জন অপরাধীকে আদান-প্রদানও করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার বলা নেই। এক বছরের নিচে সাজার কোনো অপরাধী বিনিময় এ চুক্তিতে আসবে না। তবে চুক্তিতে কোনো দেশ বন্দির আবেদন করলে তা কত দিনের মধ্যে সুরাহা করতে হবে, এমন কোনো বিধান নেই। ফলে সময়ের বিষয়টি পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারছেন না।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, পি কে হালদারকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ফিনান্সিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশের সংস্থাগুলো কিন্তু তৎপর, সজাগ আছে। এজেন্সিগুলো কাজ করছে, আপনারা দেখবেন অচিরেই তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হবে। তবে ভারতের আইনে জাল-জালিয়াতির কারণে তার বিচার হবে। সে মিথ্যা নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমাদের এখানে যে আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলাগুলো বিচারাধীন রয়ে গেছে, সেই মামলায় বিচারের জন্য তাকে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করি, দ্রুততার সঙ্গে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।

শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির পাশাপাশি রবিবার বাংলাদেশে বুদ্ধপূর্ণিমার সরকারি ছুটি থাকায় তাকে নিয়ে সরকারি কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। গতকাল রবিবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এখনো আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্র আসেনি। পি কে হালদার আমাদের এখানে অনেকগুলো মামলার আসামি। আমরা ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছিলাম। অফিশিয়াল কাগজপত্র পাওয়ার পর আমরা আইনগত যে প্রচেষ্টা, সেটা অব্যাহত রাখব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে ফেরত চাইব আমাদের দেশের মামলাগুলোর জন্য। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।’

কীভাবে ফেরানো যেতে পারে : কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে ২০১৩ সালের অক্টোবরে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তির আওতায় দুই দেশ বন্দি বিনিময় করে থাকে। এই চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে ভারতের উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। পরে নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় আলোচিত নূর হোসেনকে এই আইনে ফিরে আনা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো অপরাধী আরেক দেশে লুকিয়ে থাকলে অথবা সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে থাকলে তাকে নিজ দেশে হস্তান্তর করা যাবে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে সেই দেশে কোনো মামলা বিচারাধীন থাকলে তাকে হস্তান্তর কীভাবে করা হবে, সেই বিধান এই আইনে রাখা হয়নি।

পি কে হালদারকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়েছে ইডি। সেখানে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে থাকা মামলার বিবরণসহ ভারতে অর্থ পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে। মঙ্গলবার মামলাটি কলকাতার অর্থ পাচার আদালতে মামলা স্থানান্তর হবে। এরপর সেখানেই পি কে হালদারের বিচার কার্যক্রম চলবে। এই বিচার শেষ না হলে তাকে ফেরানো কঠিন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকের টাকা আত্মসাত্ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা চলছে। ফলে তাকে এখনো ফেরত আনতে পারেনি বাংলাদেশ। নিয়ম অনুযায়ী, বন্দিকে ফেরত আনতে হলে ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দিকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই এই প্রক্রিয়াগুলো করতে হবে। এরপর আদালতের কাছে সেই বন্দিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি চাওয়া হয়। আদালত অনুমতি দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেই বন্দিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে।

তবে কোনোভাবে পি কে হালদারকে ফেরত আনা গেলেও তার পাচার করা টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি বলেন, ‘এর আগেও আমরা দেখেছি, পাচার করা টাকা ফেরত আনা কঠিন হয়ে গেছে।’ তবে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, এর আগেও একাধিক দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনা হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে কোকোর পাচার করা টাকা ফেরত এসেছে। ফলে পি কে হালদারের পাচার করা টাকাও ফেরত আনা হবে।

পি কে হালদারকে ফেরত দেওয়ার ইঙ্গিত : পি কে হালদারকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি)। ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ-এ খবর দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পি কে হালদারকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ইডির এক জন কর্মকর্তা দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, আমরা হালদারকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে চাই। এখানের প্রক্রিয়া শেষ হলেই তাকে ফেরত দেওয়া হবে।

ইত্তেফাক/কেকে