আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায় হলো প্রাথমিক শিক্ষা, যা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অর্জন করা হয়। শিক্ষাব্যবস্থার এই ভিত্তি যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সততা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারে তা হলে কখনোই আদর্শবান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর শিক্ষার হার বেড়েই চলেছে; কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে আমরা যা আশা করি যেমন : ভালো সেবা, ভালো ব্যবহার— এসব আমরা কতটুকুই-বা পাই, এর জবাব আমাদের কারো অজানা নয়। যে কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে গেলে এই টেবিল থেকে ঐ টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে ভোগান্তির অন্ত থাকে না। সঙ্গে বাজে ব্যবহার এবং উৎকোচের দাবি তো রয়েছেই। এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে এমন নীতিগর্হিত কর্মকাণ্ডের পেছনে দায়ী হলো— ছোট থেকেই নীতিগত শিক্ষাপ্রাপ্ত না হওয়া, যেসব শিক্ষা দেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা। ফলে শতকরা হার বাড়ানো শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের অদূরভবিষ্যতে কী উপহার দেবে তা ভাববার বিষয়।
আগে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়বিমুখ হওয়ার কারণ হিসেবে ছিল দারিদ্র্য, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা, নারী শিক্ষা সম্পর্কে কুসংস্কারসহ নানাবিধ সামাজিক প্রতিবদ্ধকতা। গত দুই দশকে এসব কারণ দূর করে বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের উপস্হিতির হার এখন বেশ লক্ষণীয়। তাছাড়া সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী উদ্যোগ তথা বিনা মূল্যে বই বিতরণ, টিফিনের ব্যবস্থা, বিনা বেতনে অধ্যায়ন ইত্যাদি বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের গমনের হার বাড়িয়ে তুলছে, সহায়তা করছে উপস্হিতির হার বাড়াতে। তবে আদর্শ জাতি গঠনের জন্য কিংবা সেবাধর্মী মৌলিক মানবীয় গুণসম্পন্ন যে ধরনের মানুষ প্রয়োজন তা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় লক্ষণীয় নয়।
দেশের অনেক বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের আধিক্য থাকলেও তা চলছে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে। তিনি একাই গোঁজামিলে চালিয়ে নিচ্ছেন ১০০ থেকে ১৫০ ছাত্রছাত্রীর পাঠদান কার্যক্রম। যেখানে উন্নত বিশ্বের দিকে দেখলেই বোঝা যাবে তারা মাত্র কয়েক জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের বরাদ্দ রাখেন। আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মানি আশানুরূপ না হওয়ায় শিক্ষকগণও আন্তরিকভাবে পাঠদান করতে চান না। সাম্প্রতিক সময়ে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু সমস্যা, যা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। উপরন্তু এসব সমাধানের উপায় না খুঁজে বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি অক্ষুণ² রাখতে পরীক্ষার সময় টার্গেট ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে যাতে কেউ ফেল না করে।
এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রথমত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যেহেতু শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন সেক্ষেত্রে তাদেরকে যথেষ্ট নীতিবান হতে হবে, যেন তাদের নীতির আদর্শ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন। শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়—এমন শিশুর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টিতে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই শিক্ষককে তার নিজের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন জানা দরকার, তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দের সঙ্গে পাঠদানের পদ্ধতিও জানা দরকার।
সুতরাং প্রাথমিক স্তরে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং এ খাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ করার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। আর এটিই হতে পারে একটি ‘শতভাগ’ শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের মূলমন্ত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়