বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কৃষি পেশা ও কৃষকের অধিকার

আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৬:৫৬

কৃষি একটি মহান পেশা। কৃষকের উত্পাদিত ফসল থেকে প্রাপ্ত খাদ্য খেয়েই আমরা বেঁচে থাকি। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষক প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ আমাদের দেশের কৃষকেরা সবচেয়ে বঞ্চিত, কৃষকের অস্তিত্ব জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। কৃষক যদি খাদ্যোত্পাদন না করত, তাহলে আমরা আজ আরামআয়েশ করে খেতে পারতাম না।

কৃষি পৃথিবীর আদিমতম পেশা। প্রাচীনকালে সবাই কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। পরিবারকেন্দ্রিক কৃষিপণ্য চাষাবাদের রীতি ছিল। শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তির উত্কর্ষ, পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে বদলে গেছে সেই প্রেক্ষাপট। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কৃষক মাঠে ফসল ফলায়। আপন সন্তানের মতো যত্ন নেয়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘরে তুলে আনে ফসল। অথচ আমাদের দেশের কৃষকেরা ন্যাঘ্য দাম পায় না। যে অর্থ খরচ করে ফসল উত্পাদন করা হয় সেই অর্থ তুলতেই হিমশিম খেতে হয়, লাভ তো দূরের কথা। দেশের ধনিক শ্রেণির চোখে কৃষক মানেই গরিব, নিচু শ্রেণির মানুষ।

অহংকারের আবরণে আচ্ছাদিত উচ্চবিত্তরা ভুলে যায়, তারা তিন বেলা যে খাবার খাচ্ছে তা আমাদের কৃষকের হাতেই উত্পাদিত। ইট-পাথরের নগরে দগ্ধ হয়ে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। যত বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী বা অফিসার হোক না কেন, আমাদের পরিচয় আমরা বাংলার কৃষকের সন্তান। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কৃষক ছিলেন। সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিকভাবে কৃষকেরা আজ বড় সংকটে। পাইকার, মধ্যস্বত্বভোগী, মুনাফালোভী, ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে কৃষকেরা বঞ্চিত। এবার ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়ে দুই টাকা কেজি পাইকারি দরে শসা বিক্রি হতে দেখে বিস্মিত হলাম। বস্তা বস্তা শসা ট্রাকে ভরে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। কৃষকের কণ্ঠে শুনতে পেলাম হাহাকার, শসা লাগাতে যে টাকা খরচ হয়েছে সেই আসল টাকাও উঠেনি। ঢাকায় যে শসা চল্লিশ টাকায় বিক্রি হয়, সেই শসা কেনা হলো মাত্র দুই টাকায়। কে বলে দুই টাকায় কিছু পাওয়া যায় না? দুই টাকায় এখনো পাওয়া যায় কৃষকের কষ্টে উত্পাদিত ফসল।

শুধু শসা নয়, এমনভাবে সব কৃষিপণ্যেই একই অবস্হা। অর্থ-বিত্তে ফুলেফেপে শুধু উন্নতি হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের, দেশের কৃষকের ভাগ্যের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হচ্ছে না। দৈন্যে অর্থকষ্টে দিন নির্বাহ করে কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে আছে বাংলার কৃষক। সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলিয়েও কৃষকেরা রয়েছে নির্বাসনে। কৃষকের এই দুঃখকষ্টের বাস্তবতা দেখে বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা কৃষি পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারো চোখে নেই কৃষক হওয়ার স্বপ্ন। সবাই চাইছে বড় চাকরি করতে, বড় অফিসার হতে। এই প্রজন্মের ১০জন তরুণকে ভবিষ্যতে কী হতে চাও? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে সবাই বলবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী হতে চাই। কেউ বলবে না আমি কৃষক হতে চাই। এই না বলার পেছনেও আমাদের সমাজ দায়ী। কারণ আমাদের সমাজ কৃষি পেশাকে সবসময় হীনদৃষ্টিতেই দেখে এসেছে।

একজন কৃষক সমাজ থেকে এত বঞ্চনা সহ্য করার পর আর চাইছে না তার সন্তানও কৃষক হোক। সে চাইছে তার সন্তান শিক্ষিত হয়ে বড় অফিসার হবে। তার ধারণা সন্তান কৃষক হলে তার মতোই কষ্ট করে মরবে। একজন বাবা নিশ্চয়ই চাইবে না তার সন্তানের দুঃখ। বর্তমান প্রজন্মের এই কৃষিকাজ বিমুখতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুজলাসুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। ফসল চাষে আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের চাইতে উত্তম। এভাবে ধীরে ধীরে কৃষিবিমুখ হয়ে পড়লে এক সময় আমাদের খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিবে। তাই কৃষি পেশার সম্মান বৃদ্ধি ও কৃষকের নাঘ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কৃষকের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। অন্য যে কোনো পেশার মতো কৃষিকে সম্মানজনক স্হানে অধিষ্ঠিত করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত কাম্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন