শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষার মান নিশ্চিত হোক

আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৬:৫৯

আসছে সরকারের অর্থ ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি নামে খ্যাত বাজেট। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৯ জুন, ২০২২ জাতীয় সংসদে ঘোষিত হবে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। এটি হবে বাংলাদেশের ৫১তম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। প্রতিটা বাজেট তৈরি করার ক্ষেত্রে মৌলিক উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি হলো দুর্বল খাতে বিনিয়োগ করে সেই খাতকে শক্তিশালী করে তোলা।

বাংলাদেশের বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষাখাত অন্যতম। জাতীয় জীবনে শিক্ষা গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলে অভিহিত করা হয়েছে। শিক্ষা জাতির উন্নতির অন্যতম পূর্বশর্ত। দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন অনেকাংশেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। যথাযথ শিক্ষাজ্ঞান ছাড়া কৃষি, সেবা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন যে খাতই হোক না, সেটার গুণগত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রত্যাশিত মানের শিক্ষা অর্জনের জন্য সার্বিক যে ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন তা থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের জন্য শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ অন্তরায় রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় অন্তরায় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নের পেছনে বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ একটা বড় ধরনের অবদান রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ১৩-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও জিডিপি মাত্র ২.৮ শতাংশ। এতে দেখা গেছে জাতীয় বাজেটের হিসাবে বা জিডিপি উভয় ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে নিছক কম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেটের আকার বড় করলেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কম। দেশের শিক্ষাবিদরা এই অপ্রতুল বরাদ্দকে গুণগতমানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। উন্নত দেশগুলো তাদের বাজেট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি।

অর্থাৎ ৩০-৩৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয় শিক্ষাখাতে, সেখানে আমাদের দেশে বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ১৫ শতাংশ। এজন্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চলমান যুগে যে পরিমাণ দক্ষ ও সৃজনশীল জনবল প্রয়োজন, তা আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে। কারণ, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ, কর্মঠ, প্রগতিশীল ও উদ্ভাবনী চেতনার মানবসম্পদ দ্বারাই এ লক্ষ্যগুলো অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান যুগে দক্ষ ও সৃজনশীল জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি সমন্বিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধি হচ্ছে না। শিক্ষাখাতে টেকসই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন আর প্রয়োজনের তুলনায় বাজেটের যে স্বল্পতা বরাবরের মতো হতাশই করছে।

পৃথিবীতে এমন একটা দেশের উদাহরণ পাওয়া যাবে না, যারা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে শিক্ষায় উন্নত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটা খাত আছে, যা শিক্ষাখাতের বাইরে। বাজেট স্বল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য হচ্ছে। এজন্য আর্থিক সচ্ছল থাকা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, যা প্রমাণ করে দেয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবেশবান্ধব কাঠামোর অপ্রতুলতা। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আজ হতাশা আর বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট। বেকারত্বের গ্লানিময় অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আজ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের পথের অন্তরায়। তাছাড়া করোনা অতিমারির ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে অবক্ষয় হয়েছে, সে রেশ এখনো বিনিদ্রিত হয়নি।

শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান পথ শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি করে দ্রুত সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তাছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়কে যদি উচ্চ শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয় তাহলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হবে। এর জন্য বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি পরিকল্পনা, সততা এবং বাস্তবায়নের মিশেল ঘটানো উচিত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে শুধু বাজেটই নয়, পাশাপাশি সময় উপযোগী শিক্ষক তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর পাঠদানে সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন