শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আবাসন খাত ও বিএইচবিএফসি 

আপডেট : ২৬ মে ২০২২, ০১:৪০

বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক নীতি অধ্যায়ে এ চাহিদার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল সূচক হিসেবে ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বিবেচনা করা হয়। আবাসন শিল্পও এই অবকাঠামোগত শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে উপযুক্ত বাসস্থান গড়ে তোলা জরুরি। 

নানা ঘাতপ্রতিঘাত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আবাসন খাত গত ৪০ বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামনের দিকে এগিয়ে চলছে, একই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই সময় দ্রুত নগরায়ণ এবং অস্বাভাবিক জনসংখ্যার বৃদ্ধি হার লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, আবাসন খাতের চাহিদাও বাড়ছে। এ ছাড়া সামাজিকভাবেও আমাদের দেশ ভিন্ন ধরনের একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট ছোট একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে চলছে। তাই ফ্ল্যাট এবং অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদাও বাড়ছে। এ ছাড়া দেশে বাড়ছে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা। আর এমন মানুষ প্রতিনিয়ত খোঁজ করছে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই।

বাংলাদেশের আবাসন শিল্প শুধু বাসস্থানই সরবরাহ করছে না, অন্নবস্ত্রসহ অন্য মৌলিক চাহিদাও পূরণ করে চলেছে। একই সঙ্গে ৩৫ হাজার উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, স্থপতি ও উচ্চতর ব্যবস্থাপকদের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। সঙ্গে রয়েছে ৩৫ লাখ শ্রমিক এবং তাদের ওপর নির্ভর করেই প্রায় ২.৫ কোটি নাগরিকের অন্নবস্ত্রের চাহিদা পূরণ হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশের জিডিপি বা মোট দেশজ উত্পাদনে আবাসন খাতের অবদান এখন ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা শুধু আনুষ্ঠানিক অবদানের হিসাব। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই খাত যে অবদান রাখছে সেটা হিসাব করলে জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হতে পারে। এই খাতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই খাতের জনশক্তির কর্মসংস্থানের স্বার্থেই এই খাতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। বিশাল অর্থনীতি আবর্তিত হয় আবাসন খাতকে ঘিরেই।

রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১-এর সফল বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ‘সবার জন্য আবাসন সমস্যার সমাধান’ ও ‘প্রতিটি গ্রাম হবে শহর’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)’ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধান, আবাদি জমি রক্ষা, সবুজ অর্থায়ন এবং গ্রামীণ পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহরে উন্নতিকরণে প্রান্তিক পর্যায়ে ঋণ প্রদানে বিশেষ গুরুত্বারোপ করছে। ফলে যেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সিটিতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ঋণ বিতরণের হার ছিল ৭৯ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলে ২১ শতাংশ, সেখানে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সিটি বাদে দেশের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলে ৬৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। দেশে গৃহায়ন ঋণের ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে হাউজিং সেক্টরে বিএইচবিএফসির অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য গৃহঋণ বাজার চাহিদার প্রেক্ষিতে করপোরেশনে নতুন নতুন ঋণ প্রোডাক্ট প্রবর্তন এবং সুদের হার হ্রাস করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিএইচবিএফসি ৮৫ হাজারেরও অধিক ঋণ হিসাবে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে এবং এর মাধ্যমে ২ লাখ ২৮ হাজার ৫৮টি হাউজিং ইউনিট নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

বিএইচবিএফসি ঋণ সেবা সহজীকরণের কাজ শুরু করেছে। জনসাধারণের সুবিধা বিবেচনায় বিএইচবিএফসি ঋণকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছে, যেমন : গ্রামীণ এলাকার জন্য ‘পল্লীমা ঋণ’, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধানে আবেদনকারীর নিজস্ব কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ‘জিরো ইকু্যইটি আবাসন ঋণ’, কৃষকদের আবাসন খাতে ঋণ প্রদানের নিমিত্ত ‘কৃষক আবাসন ঋণ’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসবন্ধু ঋণ’, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ‘নগরবন্ধু ঋণ’, ফ্ল্যাট ঋণের চাহিদা মেটাতে ‘ফ্ল্যাট ঋণ’ ও ‘ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ঋণ’, নির্মাণাধীন বাড়ি বা অসমাপ্ত নির্মিত বাড়ির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার জন্য ‘আবাসন উন্নয়ন ঋণ’ ও ‘আবাসন মেরামত ঋণ’, বহুতল ভবনে (চারতলা বা তদূর্ধ্ব) লিফট, সাবস্টেশন ও জেনারেটর স্থাপনের জন্য ‘হাউজিং ইকুইপমেন্ট ঋণ’, শরিয়াহসম্মত সুদমুক্ত মুনাফাভিত্তিক বিনিয়োগসংক্রান্ত ‘মনজিল’ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মচারীদের জন্য ‘সরকারি কর্মচারী আবাসন ঋণ’সহ মোট ১২ (বার) ধরনের ঋণসেবা চালু আছে। এসব ঋণসেবার সুদের হার, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সিলিং, পরিশোধের মেয়াদকাল, বিনিয়োগ রেশিও প্রোডাক্ট ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সুদহার বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ও সর্বনিম্ন ৭ শতাংশ এবং ঋণের সিলিং ২ কোটি টাকা।

বর্তমান সরকারের স্লোগান—‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন ও গ্রাহকদের সুবিধার জন্য ঋণের কিস্তি সোনালি ই-সেবার মাধ্যমে অনলাইনে জমা ও পরিশোধ করা যাচ্ছে। অধিকন্তু, ঋণ প্রদানের সব কার্যক্রম ই-হোম লোন তথা অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিয়েছে বিএইচবিএফসি। ই-হোম লোন কার্যক্রম চালু হলে ঋণ প্রক্রিয়াকরণ ও মঞ্জুরি দ্রুততা ও অধিকতর স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। এতে সব পর্যায়ে জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত প্রদানে সহায়ক হবে।

আবাসন খাত জাতীয় অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শ্রমঘন এই খাতে ভর করেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে অর্থনীতি। বাড়বে কর্মসংস্থান। জীবিকা নির্বাহে মানুষ কাজ পাবে। অর্থনীতিতে আরো চাঞ্চল্য ফিরবে। আবাসনশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত ৪৫৬ শিল্পেও গতি আসবে। প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাড়বে সরকারের রাজস্ব। আবাসন খাতকে আরো গতিশীল করার জন্য সরকার বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

ফ্ল্যাট এবং কমার্শিয়াল স্পেসের রেজিস্ট্রেশন কয়েক দফায় প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমানো হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন খরচ ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। যা এই খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সামগ্রিকভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার কমে যাওয়াতে ফ্ল্যাট লোনের ইনস্টলমেন্ট অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যা গ্রাহককে ব্যাংক লোনের মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ করতে আরো উত্সাহিত করবে।

আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ সৃষ্টির ফলে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের সময় অল্প কিছু চার্জ প্রদান করে এই খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করা যাচ্ছে। আশা করা যায়, এই টাকাগুলো এখন বিদেশে পাচারের পরিবর্তে দেশে বিনিয়োগ হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখবে।

আবাসন খাতকে গতিশীল করার জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এজন্য জনসাধারণের আবাসন চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের বাসস্থান-চাহিদা মেটানোর জন্য নিম্নবর্ণিত কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :

আমাদের দেশের ফ্ল্যাটের সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা নেই। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে নতুন একটা পেশাজীবী গড়ে উঠবে। এই সেক্টরে কর্মচঞ্চল তৈরি হবে। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন একদিকে যেমন এই শিল্পকে এগিয়ে নেবে তেমনি বাজারে অর্থের লেনদেনও বাড়বে।

আবাসনশিল্প রক্ষার্থে অবিলম্বে রি-ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। ক্রেতাসাধারণ, বিশেষ করে স্বল্প বা মধ্যম আয়ের মানুষের চাহিদামতো ঢাকা শহরের আশপাশে বা মিউনিসিপ্যাল এলাকার পার্শ্বে বা বিভাগীয় শহরে ১ হাজার বর্গফুট বা তার চেয়ে ছোট ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ৫ শতাংশ সুদে ৩০ বছরের কিস্তিতে ঋণ দিলে ক্রেতাসাধারণ ভাড়া সমান কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।

নগরায়ণ প্রক্রিয়াকে সামগ্রিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, বিকেন্দ্রীকরণ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর পাশাপাশি অন্যান্য জেলা বা অঞ্চলভিত্তিক টাউনশিপ পরিকল্পনা করার এখনই আদর্শ সময়।

বর্তমানে বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন-সংক্রান্ত ব্যয় ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে গেইন ট্যাক্স ৪ শতাংশ, স্ট্যাম্প ডিউটি ১.৫ শতাংশ, রেজিস্ট্রেশন ফি ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ২ শতাংশ এবং ভ্যাট ৪.৫ শতাংশ (২ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ)। অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অতি উচ্চ। এই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় আরো কমিয়ে আনা জরুরি। রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমিয়ে নিয়ে এলে নাগরিকরা সঠিক দলিল মূল্য দেখাতে আগ্রহী হবে ফলে রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।

অনেক পুরোনো ফ্ল্যাট কম দামে বিক্রি হচ্ছে পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু এই পুরোনো ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয় নতুন ফ্ল্যাটের সমান। যা গ্রহণযোগ্য নয়। পুরোনো ফ্ল্যাটে নিবন্ধন ব্যয় ২-৩ শতাংশে নামিয়ে আনলে অনেক নাগরিক তাদের মাথা গোজার ঠাঁই যেমন পাবেন তেমনি এখানে নতুন কর্মসংস্থানও হবে।

সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা আরো বৃদ্ধি পেলে আবাসন খাত সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। ফলে মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বাসস্থান সমস্যার সমাধান হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘আমাদের দেশে কোনো কুঁড়েঘর থাকবে না, প্রতিটি মানুষের একটা ভালো বাসস্থান হবে’ বাস্তবায়ন হবে। সর্বোপরি, স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশ আরো এগিয়ে যাবে।

লেখক : মহাব্যবস্থাপক, বিএইচবিএফসি

 

ইত্তেফাক/ ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন