শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা জাতি চেনার উপায় হলো তাদের বইপড়ার অভ্যাস। তবে শিক্ষিত মানুষ মাত্রই যে বই পড়ুয়া—এমনটা বলা মুশকিল। বইপড়া এমন একটি অভ্যাস, যে অভ্যাসের দরুন মানুষ কখনো ক্ষতির সম্মুখীন তো হবেই না বরং সে নির্মল আনন্দ লাভ করবে, তার জানার তৃষ্ণা তীব্রতর হবে, জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি পাবে, তার আত্মিক উন্নয়ন ঘটবে। মানুষের ভেতরকার সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত করতে বইপড়া প্র্রয়োজন।
একটা সময় ছিল যখন মা-বাবারা নিজেরাও বই পড়তেন এবং সন্তানদের পাশে বসিয়ে তাদেরকেও বই পড়ে শোনাতেন। কিন্তু কালের পরিহাসে এখনকার মা-বাবারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল-ডিভাইস, যার ফলে বর্তমান প্রজন্ম হয়ে উঠছে গ্রন্থবিমুখ। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের অভিযোগ, তারা একাডেমিক পড়াশোনা বাইরে বইপড়ার তেমন একটা সময় পায় না। এটি একটি বড় সমস্যা এই প্রজন্মের জন্য। এই বিশাল পৃথিবীর মধ্যে মানুষ যখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, তাকে ঘিরে ফেলে হতাশা, তখন বই-ই হতে পারে তার প্রকৃত সঙ্গী, হতাশা থেকে মুক্তির বাহন। চার্লস ল্যাম্ব যথার্থই বলেছেন, ‘বই পড়তে যে ভালোবাসে তার শত্রু কম’। কেবল জানার আগ্রহ নিয়ে নয়, বই পড়তে হবে আত্মাকে প্রশান্ত করার জন্য, মনের ভেতরের অযাচিত ভাবনাকে দূর করার জন্য।
এখনকার যুগে শিশুরা একটি কথাই শুনতে শুনতে বড় হচ্ছে—পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হবে, জিপিএ ৫ নামক বস্তুটিকে যে কোনো মূল্যে অর্জন করতেই হবে। এমনকি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এমনভাবে প্রভাবিত করেন, যেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাবতে শুরু করে যে— পরীক্ষায় প্রথম না হওয়া একটি মহাপাপ। এই মহাপাপ থেকে বাঁচতে ছেলেমেয়েরা একাডেমিক পড়াশোনা করতে করতেই রাতদিন পার করে ফেলে। ফলে বাইরের জগত সম্পর্কে তাদের আর জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না। অথচ এই মনমানসিকতা থেকে বের হয়ে বইপড়ার জন্য কিছুটা সময় বরাদ্দ করেও যে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে জানা সম্ভব, আত্মোন্নয়ন করা সম্ভব, মেধা-মনন বিকশিত করা সম্ভব তা তাদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাচ্ছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বই পড়তেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বই পড়তেন। চার্চিল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পৃথিবীর সব থেকে ব্যস্ত মানুষটাও নিজেকে আবিষ্কার করেন বইয়ের মধ্যে, বইয়ের মধ্যেই সে নিজের আলাদা একটি ভুবন সৃষ্টি করে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন কেবল তার ইচ্ছাশক্তি। বইপড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা, প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষাই পারে একজন মানুষকে তার হাজারটা কাজের মধ্যেও বইয়ের জন্য সময় বের করাতে। ব্যস্ততা কখনোই অজুহাত হতে পারে না। জগদ্বিখ্যাত ধনী ওয়ারেন বাফেটকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, সফলতার চাবিকাঠি কী? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন ৫০০ পৃষ্ঠা পড়’।
একক উদ্যোগে কখনোই বইপড়া সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। একটি শিশুর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। পরিবারকে বলা হয় ‘শ্বাশত বিদ্যালয়’। কাজেই বইপড়ার অভ্যাসের সূচনা হোক পরিবার থেকেই। পিতা-মাতার দায়িত্ব তার সন্তানকে একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ দানের জন্য বই পড়তে উত্সাহিত করা। স্কুল-কলেজেও ছেলেমেয়েদেরকে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার জন্য উত্সাহিত করা ও এ বিষয়ে যথোপযুক্ত উদ্যোগ নেয়া উচিত। উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, বইমেলায় যাওয়া উচিত। নিজের পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে বইমেলায় যাওয়া উচিত। বর্তমানে ‘বই বিনিময় উৎসব’ বিষয়টিও চোখে পড়ার মতো। এক্ষেত্রে একজন তার পড়া কোনো বই অন্য কারো সঙ্গে বিনিময় করতে পারে।
পৃথিবীর সব দেশেই লাইব্রেরি আছে। যেমন : ব্রিটিশ মিউজিয়াম, সাউথ কোরিয়ার স্টারফিল্ড লাইব্রেরি, আমাদের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রম্হাগার, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরী কিংবা ন্যাশনাল লাইব্রেরী। এছাড়াও পাড়ামহল্লায়ও লাইব্রেরি গড়ে উঠতে পারে। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার হার বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য যেমন কলকারখানা শিল্পকারখানা গড়ে তোলা জরুরি, তেমনি দেশের মানুষের সৃজনশীল মননের বিকাশের জন্যও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এজন্যই অধ্যাপক আবুল ফজল লাইব্রেরিকে ‘মনের হাসপাতাল’ বলে অভিহিত করেছেন। বই যেন কেবল অবসরের সঙ্গী কিংবা শুধুই অভ্যাসের বিষয়ে পরিণত না হয়ে ওঠে, বরং বইপড়া হোক মানবসংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধশালী অংশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়