বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাঙ্গামাটির ভূমিধসের ৫ বছর, এখনো সেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়েই বসবাস

আপডেট : ১২ জুন ২০২২, ২০:৫৭

রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনার ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল সোমবার (১৩ জুন)। ৩ দিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাতে রাঙ্গামাটিতে  পাহাড় ধসের এই ঘটনা ঘটে। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙ্গামাটিবাসীর মনে দেখা দেয় আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি।

পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে একদিনেই প্রাণ হারান সেনা সদস্য, নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১১৩ জন। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের ওপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ওই ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সেনা সদস্য।

নিহত সেনা সদস্যরা হলেন মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহিন আলম, ও  সৈনিক মো. আজিজুর রহমান। জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি সদরে ৬৬ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬ জন, বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন এবং কাউখালী উপজেলায় ২১ জন মিলে মোট ১১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে শিশু-৩৩, মহিলা-৩২, পুরুষ ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়।

টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এতবড় ক্ষতি হবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সেদিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পর্যটন শহর রাঙ্গামাটি।

১৩ জুন রাত থেকেই শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড আওয়াজে বজ্রপাতসহ ভারী বৃষ্টি। ভয়ে সেই রাত কাটাতে হয়েছিল রাঙ্গামাটির মানুষকে। ভোর হওয়ার পর রাঙ্গামাটি শহরের ভেদভেদী, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ ৫টি উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল রাঙ্গামাটিতে।  

পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে রাঙ্গামাটি ৯দিন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্ত সড়কে ১৪৫টি স্থানে সড়কে ভাঙন দেখা দেয়। পাহাড় ধ্বসের বিপর্যয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান সড়ক, রাঙ্গামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যায়।

এছাড়া রাঙ্গামাটির বৈদ্যুতিক গ্রিড লাইনের পোল ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে রাঙ্গামাটি শহরের ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। আর বিশুদ্ধ পানির জন্য শহরের হাহাকার পড়ে যায়। সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের দ্রুত প্রচেষ্টায় তিন দিনের মাথায় বিদ্যুৎ ও দশ দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি নৌ পথে লঞ্চ দিয়ে পানি, জ্বালানি তেল ও পণ্য পরিবহনসহ লোকজনের চলাচলের ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন।

গৃহহারা হয়ে রাঙ্গামাটির ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পানি ও খাবার সরবরাহ করে। ২০২২ সালে রাঙ্গামাটির ভয়াল পাহাড় ধসের ঘটনার ৫ বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এত মৃত্যুর মিছিল ও বিপুল পরিমাণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরও লোকজন আজও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। গেলো পাঁচ বছরে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।

আর প্রতি বছরের ন্যায় বর্ষার শুরুতেই এবারও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেলগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বেশকিছু স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে আবারও অসংখ্য বাড়ি-ঘর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে পাহাড়ের নিচে বসবাসকারীরা এখনো কেউই সরে যাওয়ার সেই প্রস্তুতি নেয়নি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার অনীহা প্রকাশ করছেন বার বার।

দিনটির কথা স্মরণ করে এ বছরও রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণহানি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসক। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এসময় তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যারা পাহাড়ের পাদদেশে যারা বসবাস করছেন তাদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনায় যেন প্রাণহানি না ঘটে, তার জন্য আগাম সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আর এইসব ব্যাপারে প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্যোগ প্রস্তুতি সভাও করা হয়েছে। সেখানে সবার সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ মোকানিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া নিদর্শনা  দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধস রাঙ্গামাটিতে সেনা সদস্য, নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১১৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি