শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লোকসংগীতের শেকড় হারানো যাবে না

আপডেট : ২১ জুন ২০২২, ০২:৪২

যুগের আধুনিকায়নে মানবসভ্যতায় ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে খাদ্যাভাস, আমাদের নিত্য জীবনযাত্রার কোথায় নেই আধুনিকায়নের চিহ্ন। যে পথ পায়ে হেঁটে বা অন্য কোনো ধীরগতিসম্পন্ন বাহনে যেতে লাগত দুই থেকে তিন দিন, সেখানে আজ যাওয়া যাচ্ছে দ্রুতগতিতে মাত্র কয়েক ঘণ্টায়। বোঝা যাচ্ছে মানুষ আধুনিকায়নের সুফল ভোগ করছে। এই পরিবর্তন আমরা সংস্কৃতিতেও দেখতে চাই।

একশো বছর আগেও নাচগান বা চিত্তবিনোদনের যে মাধ্যমগুলো মানুষের মনকে প্রফুল্ল করত সেখানেও ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। মানুষের মনের স্বাদ পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক আকারে। এই পরিবর্তনে আলাদা মাত্রা সংযোজন করলেও তা মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে ধার করে নেওয়া, আমাদের আদি সভ্যতা থেকে নয়। মূলত প্রাচীন ঐ সংস্কৃতিই আমাদের জাতির সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেয় অন্যান্য জাতির কাছে।

এই একটি সংস্কৃতি নিয়ে যদি বলতে চাই, প্রথমেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলা, সুখদুঃখের কথা বলা লোকসংগীত। এই লোকসংগীতের কথা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই অজানা, অচেনা। অজানা হবে না-ইবা কেন, তাদের কাছে কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছি আমাদের এই সংস্কৃতি আগেকার দিনে যখন আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া এসে পৌঁছায়নি, তখন কিন্তু আমাদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ এবং গোয়ালভরা গরু ছিল। এখনো আছে কিন্তু সে সংখ্যাটা কম।

জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ফসলি জমি যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে পুকুর। এই পুকুরে গড়ে উঠেছে বসতভিটা। যখন আমাদের গোলাভরা ধান কিংবা পুকুরভরা মাছ ছিল তখন ধান কাটতে বা খেত নিড়ানি, ধান কাটতে কৃষকরা জুড়ে দিত বিভিন্ন রকমের গান, যা মূলত আমাদের লোকসংগীতের একটা বড় পাওনা হয়ে উঠত তখন। এখন যদিও খেতে নিড়ানি দেওয়া হয় কিন্তু গানের সেই প্রচলনটা নেই। তবে আজকাল মোবাইলে শোনা হয় হিন্দি সিনেমার গান। আরো একটা কারণ আছে বটে। ধান আজ শ্রমিক দিয়ে কাটা হয় না। আধুনিক যন্ত্রপাতি দখল করেছে তাদের স্থান। যন্ত্র তো আর গান গাইতে পারবে না, বিকট শব্দকরা ছাড়া।

গবেষকের মতে, আমাদের এই বাংলা অঞ্চল জুড়ে আগেকার দিনে প্রায় আড়াই শ লোকগানের কথা শোনা যায়। আড়াই শ তো বাদই দিলাম এখন বিশটি গানও প্রচলিত কি না সন্দেহ। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, বাউল-মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, কীর্তন-বাউল এরকম প্রধান কয়েকটি লোকসংগীতের নাম শোনা গেলেও তার চর্চা দুই একটাও ঠিকভাবে হচ্ছে না। গানের এই যে প্রচলন, সেটা ভাটা পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবেশ পালটে যাওয়া। নৌকার বৈঠা চালানোর সময় যে সুরটা ধ্বনিত হয়, সেই ধ্বনিতে মাঝির মন নেচে ওঠে গান করার জন্য কিন্তু আজকালকার ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের উচ্চ শব্দের কারণে কার মনটা সায় দেবে—গান গাই বা শুনি! ইচ্ছে হলেও আর মাঝি আব্বাস উদ্দিনের সুরের সঙ্গে সুর ধরে গাইতে পারেন না—‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে, ছল ছলাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দইরা দিয়া’। গরুর গাড়ির প্রচলনের আগে বিয়ে হলে নতুন বরবৌ আনানেওয়া করা হতো, দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যেত মানুষ। তখন দীর্ঘ যাত্রার কারণে একটু হাওয়া পেলেই গাড়িয়াল গান জুড়ে দিতেন—‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পম্হের দিকে চাইয়া রে’। সেই পরিবেশ এখন আর নেই। সভ্যতার কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে আমাদের এই বহুলপ্রচলিত লোকসংগীত।

লোকসংগীত হারানোর ক্ষেত্রে আমাদের শ্রোতাদেরও কম দোষ নেই। আমরা লোকসংগীতকে দূরে ঠেলে দিয়েছি বলেই ধীরে ধীরে তা নীরবে দূরে সরে গেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে এই গানগুলোকে চেনানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমানে স্বল্পপরিসরে হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগ চালু করা হয়েছে। পড়ানো হচ্ছে হারানো দিনের লোকসংগীত। এর পরিধি বিস্তৃত করা সময়ের দাবি। তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভিতেও প্রচার করা হয় লোকসংগীতের গানের অনুষ্ঠান। অন্যান্য টেলিভিশনেও প্রচার হয়, যদিও সেটা খুব বেশি নয়। সবগুলো টেলিভিশনে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ের শিল্পীদের সুযোগ দিতে হবে। লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা হতে হবে বেশি বেশি। গবেষকদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো গেলে হয়তো কিছুটা ফিরিয়ে আনা যাবে হারানো ঐতিহ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন