জলবায়ুর পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও বর্তমানে তা মানুষের কর্মকাণ্ড দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হার। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে এবং ভৌগোলিক অবস্থিতির ফলে এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট বিভাগসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে সিলেট এবং সুনামগঞ্জ। অন্তত ৫০ লাখ মানুষ রয়েছে পানিবন্দি অবস্থায়।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা, অবকাঠামোগত ক্ষতিসহ খাদ্য এবং সুপেয় পানীয় জলের সংকটে সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর চিত্র। চলমান পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত দুর্ভোগ বাড়বে আক্রান্ত এলাকার জনগণের। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আরো ১৭টি জেলায় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক সংকটময় পরিস্থিতির। গবেষণা বলছে, ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কিছু পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমেরই ফলাফল। প্রতি বছর এ সময়টাতে ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলগুলোকে কমবেশি প্লাবিত করে।
তবে এবারের দুর্যোগ ভেঙেছে পূর্বের সব রেকর্ড। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, গত তিন দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২ হাজার ৪৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে— যা সচরাচর ঘটে না। চেরাপুঞ্জির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে বিভিন্ন হাওর, নদনদীর মাধ্যমে সাগরে পতিত হলেও বর্তমানে নদনদীতে চলমান অপরিকল্পিত প্রকল্প এবং হাওরে পকেট রোড নির্মাণের মতো পরিকল্পনাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে। বাধাপ্রাপ্ত পানি বের হওয়ার পথ খুঁজে না পেয়ে বিকল্প পথে প্লাবিত করছে আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যার মাশুল গুনছে লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ।
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ। নির্বিচারে বন উজাড় এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে মানুষ ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে পরিবেশের তাপমাত্রা। এই বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প। যা শক্তিশালী ঝড়ের জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে এবং একই সঙ্গে ত্বরান্বিত করছে জলবায়ু পরিবর্তনকে।
সৃষ্টি হচ্ছে অতি বৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টির। ভারতের চেরাপুঞ্জির অতি বৃষ্টি এবং তা থেকে সৃষ্ট বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকেই ইঙ্গিত করে। অপরিকল্পিতভাবে বালু, পাথর উত্তোলন, নদীদূষণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে নদীগুলো হারিয়ে ফেলছে নাব্যতা। ফলে সামান্য পানি বাড়লেই প্লাবিত করে ফেলে আশপাশের স্হলভাগ। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ডেকে না আনলেও তা দুর্যোগের তীব্রতা এবং পৌনঃপুনিকতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সিলেটের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে দখল এবং দূষণে বিপর্যস্ত সুরমা। শুষ্ক মৌসুমে নদীর উত্স মুখের ৩২ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫টি চর। ফলে বরাক নদীর পানি গতিপথ পরিবর্তন করে তা কুশিয়ারা নদীকে পরিণত করেছে সর্বগ্রাসীতে।
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের পথ প্রকৃতি নিজেই খুঁজে নেয়। পাহাড়ের ঢল বেয়ে নেমে আসা পানি হাওর এবং নদীর মাধ্যমে পতিত হতো সাগরে। তবে বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্থাপনা, যোগাযোগ উন্নয়নে হাওরে তৈরি রাস্তাঘাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে। ফলে বাড়ছে বন্যার তীব্রতা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন চলমান থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত বাড়বে ১০-১৫ শতাংশ, যা সৃষ্টি করবে আরো ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। বাড়বে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস এবং দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা।
একদিকে আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অসচেতনতা বিপর্যস্ত করে তুলছে পরিবেশকে। অন্য দিকে বিপর্যস্ত পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাবে আমরাই আবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা ক্রমেই ভুলে যাচ্ছি প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের হারকে নিয়ন্ত্রণ এবং সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির মতো মানবিক বিপর্যয় রোধে প্রয়োজন জলবায়ু সচেতনতা। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দীর্ঘমেয়াদি করতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। সাময়িক লাভ যেন দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ না হয়, সে বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দিতে হবে।
এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়িত করা গেলে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের দুর্ভোগ কমানো যেত বহুলাংশে। এ ধরনের অপ্রীতিকর এবং মানবেতর পরিস্থিতি যেন সম্ভাব্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে এখনই তত্পর হওয়া জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে। এ কাজে সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়। আগামীর দুর্যোগ হুঁশিয়ারিকে রুখে দিতে প্রয়োজন শুধু আমাদের সামান্য পরিবর্তন এবং পরিবেশবান্ধব মনোভাব। মনে রাখতে হবে— যে আচরণ আমরা প্রকৃতির সঙ্গে করব, প্রকৃতি সেটাই আমাদের ফিরিয়ে দেবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়