শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সামাজিক মনোরোগবিদ্যাই হতে পারে মানসিক রোগ প্রতিকারের উপায় 

আপডেট : ২৭ জুন ২০২২, ১৬:৩৩

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর এক প্রতিবেদন বলছে, সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন মানুষই হতাশা কিংবা অবসাদে ভুগছে। বিশেষত করোনার সময়ে যখন নিস্তব্ধতা ও একঘেয়ে বাক্সবন্দি জীবনই একমাত্র উপায়, তখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে, এমনটাই স্বাভাবিক।  

মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কথা বলা বেশ উপকারী। কিন্তু আদতে তা কি পুরোপুরি কার্যকর? ২০১৯ সালের জাতীয় বাজেটেও মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর নজির আছে। সেখান থেকেই অনুমান করা সম্ভব, বাংলাদেশে মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। 

সেজন্যেই শুধু সাধারণ পরামর্শে আর মানসিক ব্যাধি ঠিক করার আশা করা সম্ভব নয়। বরং খুঁজতে হবে প্রতিকারের উপায়। সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির মাধ্যমে এই প্রতিকার করা সম্ভব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।    

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে মানসিক অবসাদ ও হতাশা যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে।  ওই সময় মনোবিদরা সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির উদ্ভাবন করেন। মূলত মানসিক অবসাদের পেছনে কী কী সামাজিক কারণ রয়েছে, সেসব চিহ্নিত করাই এই প্রতিকারমূলক পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সামাজিকভাবে কাউকে উৎখাত করার মতো সমস্যাগুলো যে মানসিক ব্যাধিতে প্রত্যক্ষভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে, তা ওই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। 

সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিতে বিশেষজ্ঞ হতে হলে নৃতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ের সাহায্য নিতেই হবে। মজার বিষয় হলো বিশ শতকের মানসিক সুস্থতা ও শিশুর সঠিক বিকাশ নিয়ে যে জোরদার মতবাদ গড়ে উঠছিল ঠিক সেখানেই সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির অঙ্কুর মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিল।

আধুনিক বিশ্বে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। গবেষণাধর্মী এই পদ্ধতির মাধ্যমে ইংল্যান্ড বা অন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের দুর্যোগের সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় এবং নাগরিকদের হতাশা কিংবা অবসাদ দূর করারও নানা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। 

বাংলাদেশে অবশ্য সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির প্রচলন শুরু হয়নি। এর মূল কারণ সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানীদের দূরত্ব। অনেক মনোবিদই সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমতকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন অথবা গ্রহণ করেন না। অথচ ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে শিকাগোতে রবার্ট ফারিস ও এইচ ওয়ারেন ডানহামের মতো সমাজবিজ্ঞানীদের পরিশ্রমের ফলেই সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি আধুনিক রূপ পেয়েছে।

সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির একটি বিরাট অংশজুড়েই আছে স্কিজোফ্রেনিয়া, হোবোহেমিয়া নিয়ে গবেষণা। এই দুটো সমস্যাই দরিদ্র অঞ্চলে বেশি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের পল্লীঅঞ্চল বা দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলেও এসব সমস্যা বেশ স্বাভাবিক হলেও তার মাত্রা নিয়ে আশঙ্কা করার সুযোগ নেই। কারণ এ বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। 

ফারিস ও ডানহামের গবেষণা থেকে জানা যায়, 'সচরাচর মানসিক সমস্যাপীড়িত মানুষরা দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে চলে যায়।' বিষয়টি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ স্বাভাবিক। বিশেষত বাংলাদেশের রাস্তায় অনেক ছিন্নমূল মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষদের পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা হয়তো খারাপ না। 

মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্তের হার আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করছে। যা খুব দ্রুতই একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হতে পারে। বিশেষত করোনার পর সোশ্যাল আইসোলেশনের মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও অনেককে নানা মানসিক রোগে ভোগাতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম এই সমস্যা শনাক্ত করতে পেরেছে বলেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে পেরেছে। যদিও ১৯৭০ সালের পর বিভিন্ন কারণে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি উন্নত বিশ্বে আবেদন হারিয়ে ফেলেছিল। তবে করোনা মহামারীর সময়ে যেন সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি নতুন পথ দেখাচ্ছে।

বিশেষত বাংলাদেশে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি চর্চার যে ক্ষেত্র রয়েছে সেগুলো সঠিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেনা। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণার কিংবা সমন্বয়ের অভাবের ফলে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি চর্চা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিই যেন মানসিক রোগ প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। 

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন