শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা

আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ০৯:৩৫

শিক্ষকের অসীম মর্যাদা বোঝাতে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ লিখেছিলেন ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ তৈরিকল্পে ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষকে ভালোবেসে অকৃপণভাবে মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে একমাত্র শিক্ষক সমাজ। জাতির পিতা শিক্ষা ও শিক্ষককে অনেক বড় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ও অধিষ্ঠিত করেছিলেন এবং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। সবিশেষ, একটি জাতিকে সুশিক্ষায় পরিচালিত করার নেপথ্যের কারিগর শিক্ষকের ত্যাগ, সম্মান, পরিশ্রমকে যথাসাধ্য মূল্যদানের স্বরূপ ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্বশিক্ষক দিবস’ পালন হয়ে আসছে। শিক্ষক সম্প্রদায়ের এতসব সম্মানের বাস্তবতা কতটুকু চিত্রায়িত?

অতি সম্প্রতি, সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত দশ বছর ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উত্পল কুমার সরকার, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ৪১তম ব্যাচের মেধাবী ছাত্র ছিলেন, দশম শ্রেণির এক ছাত্রের ইভটিজিং ও শৃঙ্খলাভঙ্গে বাধা দিলে ঐ ছাত্র কর্তৃক স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং তত্ক্ষণাত্ মৃতু্যবরণ করেন। নীতি-নৈতিকার কতটা অবক্ষয় হলে এরকম লোমহর্ষক চিত্র দেখতে পাওয়া যায়? শিক্ষাগুরু মর্যাদা কবিতায় দিল্লির বাদশার ছেলে কেন মৌলভীকে নিজ হাত দ্বারা শিক্ষকের পায়ে পানি দিয়ে ধুয়ে দিলো না—বাদশার এই প্রশ্নে শুনে শিক্ষকের শির চিরউন্নত হওয়ার প্রেক্ষিতে শিক্ষকের মর্যাদার মাহাত্ম্য বহু গুণ বেড়ে যায়। শিক্ষককে জাতির বিবেক বলা হয়। কারণ, একটি দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা, দক্ষ কর্ণধার নির্মাণে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু হালের এই প্রেক্ষাগৃহে কী দেখছি আমরা?

শিক্ষা-ছাত্র-শিক্ষক এই তিন মিলে তৈরি হবে জাতির ভবিষ্যত্ কাণ্ডারী। এর নেপথ্যে থাকবেন শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে নির্মূল, নিখাঁদ। পিতামাতার পরে কেউ যদি আপন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি শিক্ষকই হবেন। প্রযুক্তির চরম উত্কর্ষের দরুন আমাদের নীতি-নৈতিকতা অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গেলে একজন ছাত্র এই অসম্ভব কাজটি সাধন করতে পারে! স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আঘাতটি মূলত লেগেছে কোথায় শিক্ষকের মাথায় নাকি জাতির বিবেকে? পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখব ওখানকার একজন প্রাইমারি শিক্ষককে যে পরিমাণ জীবনসম্মত বেতন, সম্মান দেওয়া হয় তার কিয়দংশও বাংলাদেশের বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের দেওয়া হয় কি না তা বোঝা মুশকিল। জাপানের স্কুলগুলোতে ছাত্রদের টানা চার বছরই নীতি-নৈতিকতার ওপর পড়ানো হয়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি জিনিসের বড়ই অভাব দেখা দিয়েছে; তা হলো প্রকৃত শিক্ষা এবং শিক্ষা গ্রহণের যথাযথ ব্যবস্থা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি একেবারে নতুন নয় বরং নিত্যনৈমিত্তিক। শিক্ষকতা পেশাকে বলা হয়, মহান পেশা। কিন্তু শিক্ষক সহিংসতা প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ সত্য আমরা বুঝব কবে? সময় এসেছে বোঝার। বঙ্গবন্ধু যেমন শিক্ষক সমাজের গুরুত্ব উপলব্ধির পাশাপাশি শিক্ষকদের নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তাদানে সচেষ্ট ছিলেন, তদ্রুপ বঙ্গবন্ধু তনয়া পদ্মাকন্যাখ্যাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষকদের সম্মান বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন। শিক্ষকদের বসিয়েছেন সম্মানের আসনে। কাজেই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের নিরাপদ জীবনযাপনে নিশ্চয়তা প্রদানে তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলেই আশা রাখি। আরো একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, সবকিছুতে সরকারের ওপর দোষ না চাপিয়ে বরং নিজেদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা দরকার।

এক্ষেত্রে, সন্তানকে সঠিক পারিবারিক শিক্ষাদানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। কেননা বলা হয়ে থাকে, সন্তানের প্রথম শিক্ষার সোপান হলো পরিবার; যেখান থেকে সে নীতি-নৈতিকতার ধারণা পাবে এবং বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে শিখবে। সর্বোপরি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সবসময় মধুর ও তাৎপর্যপূর্ণ, যা সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিকদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। শিক্ষকতার এই মহান পেশা তথা জাতির বিবেক তৈরির কারিগরদের ওপর নির্মম সহিংসতা চালানোর ঘটনা ঘটলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। আসুন, শিক্ষককে সন্মান করি— বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় সোনার মানুষ গঠনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন