‘নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে/ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ,/স্মরি ব্যথা পাই মনে....। শিক্ষাগুরু সম্পর্কে ভাবলে কাজী কাদের নেওয়াজের এ কবিতাটিই প্রথমে মনে আসে। মোগল বাদশাহ আলমগীরের পুত্রের শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার দৃশ্য দেখার পর বাদশাহ ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন এই কারণে যে, তার পুত্র শুধু কেন পানি ঢেলেছিল; কেন সে নিজ হাত দিয়ে শিক্ষকের পা ভালোভাবে ধুয়ে দেয়নি। এই একটিমাত্র দৃশ্যই এটা প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে, শিক্ষকের আসন সর্বাপেক্ষা উঁচুতে। একজন মানব সন্তানকে প্রকৃত মানবরূপে গড়ে তোলার আড়ালে পিতা-মাতার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। মানুষ তৈরির দায়িত্বের বেশির ভাগই শিক্ষক পালন করে থাকেন। পরম যত্নে শিক্ষার্থীর মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শে তাকে প্রস্ফুটিত করে তোলেন।
আমাদের দেশ আধুনিক হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে আমরা উন্নত হতে পারছি কি? আমরা কি পারছি জাতি গড়ার কারিগরদের প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে? আজ নকলে সহায়তা না করলে কিংবা বাধা দিলে শিক্ষককে পরীক্ষার হলে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, আহত করা হচ্ছে, রুমে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে, শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে, শিক্ষককে পুকুরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, নিকটবর্তী অতীতের খবরের কাগজে আমরা এমন সংবাদই দেখতে পেয়েছি। কয়েক বছর আগেও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরা এমপিওভুক্তির দাবিতে শূন্য থালা নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে দেখেছিলাম শিক্ষকদের। আজও বেতন-ভাতাজনিত সমস্যা, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করাসহ নানাভাবে হয়রানি হচ্ছেন শিক্ষকরা। প্রশ্ন উঠছে, কেন আজ তথাকথিত মাতবররা কিংবা প্রভাবশালী পরিবারের শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে নানাভাবে হেনস্তা করছেন? কোন অপরাধে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো হবে? রাষ্ট্রে কি আইনকানুন নেই? কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ এমন করতে পারে? শিক্ষার্থীকে শৃঙ্খলা, নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়াটা কি অপরাধ?
একজন রাষ্ট্রপতি, একজন চিকিৎসক, একজন আইনজীবী, একজন বিজ্ঞানী প্রত্যেককেই তার অবস্থানে পৌঁছে দেন শিক্ষক। স্নেহের পরশে লালন করেন, স্বপ্নের সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ করে দেন, এক বা একাধিক শিক্ষক। কিন্তু বস্ত্তত সেই শিক্ষকদের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয় না, সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হয় অনেককেই। তবু তারা বেছে নেন জ্ঞান বিতরণের মহান পেশা, এগিয়ে যান মহান ব্রত নিয়ে। অতীতে কিংবা বর্তমানে যতজন ব্যক্তি মহান হয়েছেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিজের নাম উজ্জ্বল করে লিখে গিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন শিক্ষাগুরুর প্রতি নমনীয়, প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু।
সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুটো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সাভারে দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে তার শিক্ষককে হত্যা করেছে। অন্যদিকে নড়াইলে একটি কলেজের অধ্যক্ষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং হাজারো মানুষের সামনে জুতার মালা গলায় পরতে হয়েছে। এক জন তো মারা গিয়েছেন, আরেক জন বোধহয় জীবিত অবস্থায়ই মৃৃতু্যর স্বাদ পাচ্ছেন। এ দুটো ঘটনার প্রকৃত বিচার হবে তো? নাকি অতীতের নানা ইস্যুর মতো আরেকটি ঘটনা এসে এই ঘটনাকে চাপা দিয়ে যাবে। এখন কয়েক দিন মানববন্ধন-প্রতিবাদ হবে তারপর সবাই ভুলে যাবে—এমনটাই ঘটবে না তো! অপরাধের যদি বিচার না হয় তাহলে অপরাধীর সংখ্যা তো কমবে না সমাজে। এ দুটি ঘটনার যদি যথাযথ বিচার না হয়, তবে অন্ধকার ভবিষ্যতের শঙ্কার কথা ভাবলে ভুল হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের মারপ্যাঁচে বেরিয়ে যাওয়া এসবই অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ, ছাত্রসমাজের অবক্ষয়ের মূল কারণ। আমরা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখতে চাই না, শিক্ষক হত্যার ঘটনাসহ শিক্ষক অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। সর্বমহল থেকে আওয়াজ উঠুক ‘শিক্ষক শ্রেষ্ঠ সবার’।
হ লেখক :শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়