বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

অর্থনীতির ক্ষত ‘মানি লন্ডারিং’

আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২২, ০২:০৪

বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং বলতে আমরা বুঝি অবৈধ অর্থ বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করা বা উৎসকে গোপন করা, কিংবা বাণিজ্যিক লেনদেনের কারচুপির মাধ্যমে আয়ের উৎস সৃষ্টি করে সেই অবৈধ আয়কে বৈধ করার চেষ্টা করা। মূলত তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে মানি লন্ডারিং।

যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে Stage of Money Laundering. অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢোকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানি লন্ডারিং। এটি হতে পারে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ডিপোজিটের মাধ্যমে ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখার মাধ্যমে; অর্থনীতির পরিভাষায় এ ধাপটি পরিচিত ‘Placement’ নামে। এরপর শুরু হয় লেনদেন। অর্থা প্রাথমিকভাবে অর্থ ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হলে তা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া অ্যাকাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এ ধাপকে বলা হয় ‘Layering’। আর শেষ ধাপটি পরিচিত ‘Intergration’ বা সমন্বয়করণ নামে। অর্থাৎ এ ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও মানি লন্ডারিংকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু সবসময় যে এ তিন ধাপে ব্যাপারটি ঘটে এমন নয়। ইলেকট্রনিক মানি, অফশোর ব্যাংকিং, ডার্ক ওয়েবের কারণে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াটি আরো জটিল হয়ে উঠছে দিনদিন।

সাধারণভাবে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং ঘটে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে বৈশ্বিক আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৩ সালে এসে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ধারণা, কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অর্থ পাচারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

আমাদের দেশে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। এটা জারির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতকে অপরাধমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সরকারের সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে। তা বাস্তবায়নে বিএফআইইউ বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে। তার পরও অভিযোগ ওঠে অর্থপাচারের। প্রতিটি দেশেই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশে অর্থ পাচার এক বিরাট বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অর্থ পাচার নিরোধ বা বন্ধের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ পাশ হয়েছে; যা ২০১৫ সালে প্রয়োজনের নিরিখে আংশিক সংশোধিত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, বৈধ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে অর্থ-সম্পত্তি প্রেরণ বা পাচার কিংবা দেশের বাইরে উপার্জিত সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, তা ফেরত না আনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্জিত অর্থ বা প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

অর্থ পাচারের মূল উৎস বা মাধ্যম নানামুখী, যেমন—বিদেশে বিনিয়োগের আড়ালে অর্থ পাচার, দুর্নীতি বা অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার মতো অবৈধ ব্যবসা-অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পাচার, ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’ বা মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার, উন্নত সুযোগ-সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে রাখা এবং নিজেও গোপনে ঐ দেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য অর্থ পাচার করে জমা করা, অনেক সময় দেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ভবিষ্যতে অস্হিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী ‘নিরাপদে’ দেশে অর্থ পাচার করেন, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ‘ট্রান্সফার মিস প্রাইসিং’-এর মাধ্যমেও অর্থ পাচারের সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলা আগে তদন্ত করত শুধু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু তদন্ত নয়, মামলা দেখাশোনাও করত দুদক। তবে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুদুকসহ পাঁচটি সংস্থা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। এটি একটি প্রশংসাসূচক উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সর্বপ্রথম সরকার এবং তারপর গঠিত সহযোগী সংগঠনসমূহকে সুচারুভাবে তদন্তপূর্বক কাজ করতে হবে। মানি লন্ডারিংকে বলা হয়ে থাকে ‘অর্থনীতির ক্ষত’। কাজেই, এ বিষয়টিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন