বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্মার্টফোন যেন মানুষের কৃত্রিম অঙ্গ 

আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২২, ০০:৪৫

আগের যুগে রাজা-বাদশাহরা শাসন কর্তা ছিলেন; এখনকার যুগে রাজা-বাদশাহর ভূমিকায় ‘স্মার্টফোন’—শাসন করছে তথাকথিত সভ্য সমাজের মানুষকে! আমাদের শরীর হার্ট, ফুসফুস, পাকস্থলী ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো ছাড়া যেমন আমরা চলতে পারি না, তেমনি বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন নামক ডিভাইস ছাড়া চলাও যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মানব শরীরের কৃত্রিম অঙ্গের ভূমিকা পালন করছে স্মার্টফোন, যার অনুপস্থিতিতে জীবন প্রায় অচল। 

উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। প্রায়ই কিছু গাইড বইয়ের ওপর লেখা থাকে— ‘একের ভিতর দুই’, ‘একের ভিতর পাঁচ’, ‘একের ভিতর অনেক’ ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণ। আধুনিক যুগের মোবাইল ফোন ‘একের ভিতর অনেক’ নামক বিশেষণ নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে। একের ভেতর অনেক বলতে মূলত বুঝানো হয়েছে একটি ডিভাইসের দ্বারা মালটিপল সুবিধা পাওয়া। যেমন :এর দ্বারা সংবাদপত্র পড়া, টিভি দেখা, লাইভ খেলা দেখা, ছবি তোলা, এলার্ম-ঘড়ি, অডিও, ভিডিও, রেকর্ডিং করা, গান শোনা, নানান বিল পরিশোধ করা, লেনদেন করা ইত্যাদি। মোট কথা, মোবাইলের বেড়াজাল আমাদের এমনভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, মন চাইলেই এটি ব্যবহার করা থেকে আমরা বিরত থাকতে পারি না। কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এটিকে হাতের নাগালে রাখতেই হচ্ছে। অপর দিকে স্মার্টফোনের কিছু অ্যাপস; যেমন—ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার, টিকটক, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদির দাপট লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেসবুক নিঃসন্দেহে মানুষকে কানেক্ট করতে এবং গ্লোবাল ভিলেজ তৈরি করতে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু যেসব মানুষের সেল্ফ কন্ট্রোল কম, তারা সহজেই ফেসবুকের নেশায় পড়ে নষ্ট করছে অগণিত সময়। স্মার্টফোন শুধু যে তরুণ সমাজকে ইচ্ছামতো নাচাচ্ছে তাই না, ঘরের শিশু বাচ্চাটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মা-বাবা এটি অনায়াসে ব্যবহার করছেন। সামগ্রিক সিস্টেমটাই যেন ‘লস’ হয়ে গেছে; অর্থাৎ শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত কমবেশি সবাই মোবাইলে আসক্ত হয়ে সময়ের অপচয় করেই চলেছে। প্রকৃতিতে যে বাস্তুতন্ত্র আছে এর ব্যতয় ঘটলে যেমন ফলাফল হিসেবে যেমন ঘটে ঘূর্ণিঝড়, তুফান, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেমনি মোবাইল ফোন আমাদের মানসিক ইকোসিস্টেম লসের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আর এর আউটপুট হিসেবে আমরা পাচ্ছি— মাথাব্যথা, হতাশা, অবসাদ, অস্থিরতা, অনিদ্রা, খাবারে অরুচি ইত্যাদি। অফিসের উচ্চস্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মকর্তা সবার হাতেই স্মার্টফোন থাকাটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে আজকের সমাজে। মানুষের সামগ্রিক চিন্তাশক্তিতে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। এখন ইচ্ছা করলেই কোনো কিছুতে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। সব সময় কোথাও যেন একটা অস্থিরতা কাজ করে। আমাদের এই ইমোশনটাকে কন্ট্রোল করতে না পারলে এক সময় তা ভয়াবহ রূপ নেবে।

২০২০ সালের অক্টোবরের ৭ থেকে নভেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয় ৬০১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ওপর। মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পর্কিত এ গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মাত্রাতিরিক্ত ফোন চালায়। ডাটা রিপোর্টাল ২০২১ সালে গবেষণা করে তাদের ফলাফল প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, বিশ্বে মোবাইল ব্যবহারকারী ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে জানুয়ারি ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২১ সালের মধ্যে। টেক রিপাবলিক ২০২০ সালে দেখায়, আমেরিকানরা দিনে ১৬০ বার তাদের ফোনে প্রবেশ করে অর্থাৎ প্রতি ৯ মিনিটের মধ্যে এক বার। এসব গবেষণার দিকে তাকালে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হয়। মানবসমাজ কোন দিকে যাচ্ছে? কেনইবা মোবাইলের মায়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না আমরা? এমন হাজারও প্রশ্ন মনে জাগে। 

নিঃসন্দেহে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে স্মার্টফোনের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং এটি আমাদের জীবনযাত্রাকে এতটা সহজ করেছে, যা অনেকটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, অতিমাত্রায় এর ব্যবহার এনে দিতে পারে বড় বিপর্যয়। সাম্প্রতিক সময়ে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার কমিয়ে জীবনকে উপভোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বয়ং মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক মার্টিন কুপার। এমতাবস্থায়, কীভাবে আমরা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বাঁচতে পারি— এটাই এখন বড় প্রশ্ন। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় অনুসরণ করা যেতে পারে; যেমন—অপ্রয়োজনে হাতের নাগালে ফোন না রাখা, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা। হুটহাট ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক না করা। বই ও পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করা। ভার্চুয়ালি গেম না খেলে সম্ভব হলে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা। কতক্ষণ সময় মোবাইলে ব্যয় করব তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থাকলে, বিভিন্ন কাজের জন্য মোবাইলের বদৌলতে এগুলো ব্যবহার করা—এগুলো পেশাজীবনে বেশ কাজে দেয়। সর্বোপরি, মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একটি সতর্কবাণী শুনতে পেয়েছি আমরা—‘এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকেই তরুণ প্রজন্ম অলস-অশিক্ষিত গোষ্ঠীতে পরিণত হবে!’

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন